বারবার বিল পরিশোধ ও রেমিট্যান্স জালিয়াতিতেও অর্থ হাতিয়েছেন শামস্‌-উল!

বারবার বিল পরিশোধ ও রেমিট্যান্স জালিয়াতিতেও অর্থ হাতিয়েছেন শামস্‌-উল!

নিজস্ব প্রতিবেদক, বাঙলার কাগজ ও ডন; রাহাতুল রাফি : নামের আগে ‘মোহাম্মদ’ শব্দটা ঠিকই আছে, তাও আবার জামায়াতিদের স্টাইলে। ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী মো. থাকতে বাধা নেই, তবে নাম যখন প্রকাশ পায়, তখন অধিকাংশক্ষেত্রেই মো. আর শ্রী এসব প্রকাশ করা হয় না। অথচ শামস্‌-উল নামের আগে এমনভাবেই মো. (মোহাম্মদ) সাটিয়েছেন, তা প্রকাশ করা ছাড়া ‘উপায় কোথায়’! এই তো গেলো একটি বিষয়। দ্বিতীয় বিষয় হলো- সিলেট হলো জামায়াতের ‘রাজধানী’। বাংলাদেশের জামায়াত-শিবির এবং জঙ্গিবাদের আস্তানা বলা চলে সিলেটের কিছু জায়গাকে। যদিও সিলেট অনেক পূত ও পবিত্র। তবে সিলেটের অনেক আওয়ামী লীগের নেতাকেও জামায়াতের লেজুরবৃত্তির রাজনীতি করতে হয়, কারণ সিলেটে জামায়াত অনেক বেশি পরিমাণে। আর এই অবস্থায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক খাতের অগ্রণী ব্যাংকের সদ্য সাবেক হওয়া ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ শামস্‌-উল ইসলামের তো আবার একটু জামায়াতপ্রীতি বেশিই। আবার তাঁর বাড়িও সিলেটে। এ অবস্থায় তিনি তাঁর এলাকার জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িতদের বেশ সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেছেন বলেই জানা গেছে। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীদের সঙ্গে এমন যখন সখ্য, তখন তো তিনি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক লুটপাট করবেনই, এটাই স্বাভাবিক। কারণ এটা যে বাংলাদেশের ব্যাংক। আর ঠিক তাই হয়েছে। তাইতো অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শামস্‌-উল ইসলাম যোগসাজশের মাধ্যমে একই প্রতিষ্ঠানকে বারবার রপ্তানি বিল প্রদানের মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। কয়েক শ কোটি টাকা অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে রেমিট্যান্স জালিয়াতির মাধ্যমেও।

অভিযোগের ব্যাপারে জানার জন্য সোমবার (১০ এপ্রিল) অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শামস্‌-উল ইসলামের মুঠোফোনে খুদেবার্তা পাঠিয়ে ফোন দেওয়া হয়। তিনি ফোন ধরেন। তবে বাঙলার কাগজের পরিচয় দেওয়ার পর তিনি বলেন, ‘আমি একটু ব্যস্ত আছি।’ এই বলেই তিনি কলটি কেটে দেন।

বারবার বিল পরিশোধ করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া : একই পণ্যের মূল্য গ্রাহককে দুবার পরিশোধ করেছে অগ্রণী ব্যাংক। মাত্র এক বছর তিন মাস ১৮ দিনের ব্যবধানে এই ঘটনা ঘটেছে ১৪ বার। এর মাধ্যমে গ্রাহককে দেওয়া হয়েছে ৭৪ কোটি ৫৭ লাখ ১২ টাকা। যদিও পণ্য এসেছে ৩৭ কোটি ২৮ লাখ ৬৭ হাজার ৫০৬ টাকার। ২০১৯ সালে মোহাম্মদ শামস্‌-উলের আমলে এই ঘটনা ঘটে। এক্ষেত্রে তদন্তদলকে স্বাক্ষরবিহীন ও ডুপ্লিকেট শিট প্রদানের মাধ্যমে ভুল তথ্য প্রদানেরও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে উঠে এসেছে, ম্যাগপাই গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান মেসার্স ম্যাগপাই নিটওয়্যার লিমিটেডকে রপ্তানি বিলের বিপরীতে ১৪ বার দ্বিগুণ টাকা দিয়েছে অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান শাখা। ২০১৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর প্রথম রপ্তানি বিলটির জন্য পরিশোধ করা হয় ৪৬ লাখ ৫৮ হাজার ৩০৮ টাকা। একই বিলের জন্য সমপরিমাণ টাকা দ্বিতীয়বার গ্রাহকের ব্যাংক হিসাবে পাঠানো হয় ২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর।

একইভাবে প্রতিষ্ঠানটির হিসাবে দ্বিতীয় রপ্তানি বিল বাবদ ২০১৮ সালের ২২ অক্টোবর জমা হয়েছে দুই কোটি ৭৬ লাখ ছয় হাজার ৮০৪ টাকা। একই বিলের সমপরিমাণ অর্থ গ্রাহকের হিসাবে পাঠানো হয়েছে ২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর। তৃতীয় বিলের তিন কোটি ২১ লাখ ৯৬ হাজার ৬৩৫ টাকা ২০১৮ সালের ২৪ ডিসেম্বর জমা করা হয়েছে গ্রাহকের হিসাবে। এই বিলের সমপরিমাণ অর্থ আবারও গ্রাহকের হিসাবে পাঠানো হয় ২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর। একইভাবে ২০১৮ সালের ৫ নভেম্বর এক কোটি ১৫ লাখ ১০ হাজার ৪৩৪ টাকার রপ্তানি বিল জমা হলেও একই বিলের সমপরিমাণ অর্থ দ্বিতীয়বারের মতো গ্রাহকের হিসাবে জমা করা হয় ২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর। পঞ্চম বিল হিসেবে দুই কোটি ১৯ লাখ ৬৯ হাজার ৯৮৫ টাকা ২০১৮ সালের ২২ নভেম্বর গ্রাহকের হিসাবে জমা করলেও সমপরিমাণ অর্থ আবারও ২০১৯ সালের ১৭ নভেম্বর গ্রাহকের হিসাবে পাঠানো হয়। ষষ্ঠ বিলটি পরিশোধ করা হয় ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর, যার পরিমাণ তিন কোটি ৩৬ লাখ ৯২ হাজার ১৭ টাকা। তবে দ্বিতীয়বার একই বিলের সমপরিমাণ অর্থ পাঠানো হয় ২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর।

প্রতিবেদনে আরও দেখা গেছে, সপ্তম বিলের বিপরীতে তিন কোটি ২৪ লাখ ১০ হাজার ৮১৯ টাকাও দুবার গ্রাহকের হিসাবে পাঠিয়েছে অগ্রণী ব্যাংক। এর মধ্যে প্রথম তারিখটি হলো ২০১৯ সালের ১৯ জানুয়ারি এবং দ্বিতীয়টি পাঠানো হয় একই বছরের ১৫ ডিসেম্বর। অষ্টম বিলের তিন কোটি ৭৪ লাখ ৯৭ হাজার ৩৪৪ টাকা গ্রাহককে পাঠানো হয় ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ২৭ তারিখ। দ্বিতীয়বারে বিলটির সমপরিমাণ অর্থ একই বছরের ১৫ ডিসেম্বর গ্রাহকের হিসাবে পাঠায় অগ্রণী ব্যাংক।

নবম বিল হিসেবে ২০১৯ সালের মার্চ মাসের ২৮ তারিখ দুই কোটি ৬৮ লাখ ৩৬ হাজার ৯৮৪ টাকা পাঠানো হয়। তবে একই বিলের জন্য পাঠানো অনিয়মের টাকাটি পাঠানো হয়েছে একই বছরের ১৫ ডিসেম্বর। ১০ নম্বর বিলের বিপরীতে তিন কোটি ৩৭ লাখ ১৫ হাজার ৫৩১ টাকা পাঠানো হয় ২০১৯ সালের ১৮ মার্চ। সমপরিমাণ টাকা আবারও পাঠানো হয়েছে একই বছরের ১৫ ডিসেম্বর। ১১ নম্বর রপ্তানি বিলের মূল্য ছিলো এক কোটি ৫৪ লাখ ১৩ হাজার ৪৩০ টাকা। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় টাকাটি গ্রাহকের হিসাবে পাঠানো হয় ২০১৯ সালের ২২ মে। তবে অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় টাকাটি আবারও গ্রাহকের হিসাবে ১৫ ডিসেম্বর পাঠিয়েছে ব্যাংক। ১৪টি বিলের মধ্যে ১২ নম্বর বিলের দুই কোটি ৭৭ লাখ ৯৪ হাজার ১১৩ টাকা পরিশোধ করা হয় ২০১৯ সালের ৩০ মার্চ। দ্বিতীয়বার সমপরিমাণ টাকা গ্রাহকের হিসাবে পাঠানো হয় ৩০ ডিসেম্বর। আর ১৩ নম্বর বিলের তিন কোটি ৩৪ লাখ ৮২ হাজার ৬৬২ টাকা পরিশোধ করা হয় ২০১৮ সালের ৫ ডিসেম্বর। একই বিলের সমপরিমাণ টাকা আবারও ২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর গ্রাহকের হিসাবে পাঠায় অগ্রণী ব্যাংক। আবার ১৪ নম্বর বিলের বিপরীতে তিন কোটি ৪০ লাখ ৮২ হাজার ৪৪০ টাকা ২০১৯ সালের ২৩ মার্চ গ্রাহকের হিসাবে পাঠানো হয়। সমপরিমাণ টাকা আবারও ৩০ ডিসেম্বর পাঠানো হয়েছে গ্রাহক বরাবর।

অগ্রণী ব্যাংকের যে বিভাগে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন সম্পন্ন হয়, তার নাম ফরেন কারেন্সি অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট ডিভিশন (এফসিএমডি)। রপ্তানি বিলের সব টাকা এসে জমা হয় এই বিভাগে। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় গ্রাহকের রপ্তানির টাকা পরিশোধের জন্য ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা এমওডিএ বা ডেবিট অ্যাকাউন্ট তৈরি করে এফসিএমডিতে জমা দেয়। এর প্রেক্ষিতে শাখা বরাবর টাকা পাঠায় সংশ্লিষ্ট বিভাগটি। সেই টাকা আবার গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেয় শাখা। কিন্তু একই বিলের বিপরীতে সমপরিমাণ টাকা দ্বিতীয়বার পাঠানোর কোনও নিয়ম বাংলাদেশে নেই।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, তদন্ত চলাকালে প্রধান শাখা বরাবর প্রয়োজনীয় নথিপত্র সরবরাহ করার জন্য বিভিন্ন সময়ে মৌখিক এবং তিনবার লিখিতভাবে অনুরোধ করা সত্ত্বেও তা সরবরাহ করে নি অগ্রণী ব্যাংক। যেসব নথিপত্র, ভাউচার, রিয়েলাইজেশন শিট, সুইফট কপিসহ বিভিন্ন কাগজ সরবরাহ করা হয়েছে, তার অধিকাংশই স্বাক্ষরবিহীন ও ডুপ্লিকেট (নকল)। এমনক্ষেত্রে সূত্রগুলোর দাবি, বিলগুলোর অধিকাংশই সমন্বয় করা হয়েছে দাবি করা হলেও, বিলগুলো যে সমন্বয় করা হয় নি, তা পরিস্কার। কারণ কাগজ সরবরাহের ক্ষেত্রে অধিকাংশই ছিলো স্বাক্ষরবিহীন ও ডুপ্লিকেট।

এমন অনিয়মকে ইচ্ছাকৃতই মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, এই কর্মকাণ্ডে শুধু এক পক্ষ নয়, উভয়পক্ষের যোগসাজশ রয়েছে। তাই জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। পরবর্তীকালে গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের এলসি খোলার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা উচিত। ব্যাংকের অন্যান্য সেবা বাতিল ও সিআইবিতে রিপোর্ট করতে হবে। কোনও কঠোর ব্যবস্থা না নিলে, এসব অনিয়ম দূর হবে না। আর এ ধরনের অনিয়মে ব্যাংকের (তৎকালীন) ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত, তাহলেই এসব জালিয়াতি হবে না।

রেমিট্যান্স জালিয়াতি : দেশে পরিবার-পরিজনের কাছে টাকা পাঠান প্রবাসী বাংলাদেশিরা। টাকা জমা হওয়ার পরপরই সেই টাকা ট্রান্সফার হয়ে যায় কোনও নারীর অ্যাকাউন্টে। সেখান থেকে টাকা তুলে নিয়ে যায় তৃতীয় কোনও পক্ষ। নিজের স্বাক্ষরিত চেকে টাকা ট্রান্সফার হলেও কিছুই জানে না প্রবাসীরা। যখন জানতে পারেন, তখন তাঁদের মাথায় হাত। অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা হাওয়া। অগ্রণী ব্যাংকের একটি জালিয়াত চক্র এভাবেই অন্যের অ্যাকাউন্টের টাকা কৌশলে নিজের অ্যাকাউন্টে জমা করেছে। মোটা অঙ্কের টাকা তোলার পর ওই অ্যাকাউন্ট হোল্ডারও গায়েব। ডাক বিভাগ ও অগ্রণী ব্যাংকের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এভাবেই জালিয়াত চক্র কৌশলে হাতিয়ে নিয়েছে কয়েক শ কোটি টাকা। 

সূত্র জানায়, মাত্র ১ বছরেই প্রতারক চক্র তুলে নিয়ে গেছে প্রায় ২ শ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে ঢাকা, সিলেট, মুন্সীগঞ্জ ও চট্টগ্রামের ব্যাংকগুলোতে এ ধরনের জালিয়াতি হয়েছে। এ ধরনের জালিয়াতিতে অগ্রণী ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারাও জড়িত বলে জানা গেছে। ঘটনাগুলো ঘটেছে অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শামস্‌-উল ইসলামের আমলে।