বাজেট : পরোক্ষ রাজস্ব আয় বাড়াতেই মনোযোগ

বাজেট : পরোক্ষ রাজস্ব আয় বাড়াতেই মনোযোগ

বিশেষ প্রতিবেদক, বাঙলার কাগজ : বড় বাজেটে ব্যয়ের বিপুল চাপ সামলাতে রাজস্ব আয় বাড়াতে মনোযোগী সরকার। আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরতা বজায় রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছে। আর অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, এ প্রবণতা পাল্টাতে হবে; বৈষম্য কমাতে জোর দিতে হবে প্রত্যক্ষ করে, বাড়াতে হবে এর পরিমাণ।

জাতীয় বাজেটের ব্যয় মেটাতে অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণের বড় অংশই আসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে কর ও শুল্কের রাজস্ব আয় থেকে। চলতি অর্থবছরের বাজেটের ধারাবাহিকতায় আগামী অর্থবছরেও প্রত্যক্ষ করে নজর দেশের রাজস্ব আদায়ের প্রধান এ সংস্থার।

আগামী বাজেটের প্রস্তাবিত খসড়ায় এনবিআরের মাধ্যমে আদায় হওয়া মোট রাজস্বের প্রায় ৬৪ শতাংশই পরোক্ষ কর হিসেবে বিবেচিত ভ্যাট ও শুল্ক খাত থেকে আদায়ের পরিকল্পনা চলছে; নীতি নির্ধারকদের পরামর্শে যা কাঁটাছেড়া করে একটি আকার দেওয়ার চেষ্টা করছেন বাজেট সংশ্লিষ্টরা কর্মকর্তারা।

অন্যদিকে প্রত্যক্ষ করের মূল খাত আয়কর থেকে মোট রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার ৩৬ শতাংশের বেশি আহরণের পরিকল্পনা করছে এনবিআর; যা বাড়াতে দীর্ঘদিন থেকে পরামর্শ দিয়ে আসছেন অর্থনীতিবিদরা। সংস্কার কার্যক্রম, ডিজিটাল পদ্ধতি চালু, ব্যাপক প্রচারণার মতো নানামুখী চেষ্টাতেও গত কয়েক বছর ধরে যা বাড়াতে বেগ পেতে হচ্ছে রাজস্ব বোর্ডকে।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, প্রত্যক্ষের চেয়ে পরোক্ষ করে জোর দেওয়ার বিদ্যমান নীতি বজায় থাকলে দেশে বাড়তে থাকা আয় ও সম্পদ বৈষম্য দূর করা খুবই কঠিন হবে। এ ব্যবধান কমাতে প্রতিবেশীসহ উন্নত দেশের মতো প্রত্যক্ষ করেই জোর দিতে হবে।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বাঙলার কাগজকে বলেন, রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থার কারণেও দেশে আয় ও সম্পদ বৈষম্য বাড়ছে। এই বৈষম্য কমানো এবং রাজস্ব আহরণের গতি বাড়ানোর জন্য প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর কোনও বিকল্প নেই।

ভারতের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, পাশের দেশ ভারতেও মোট রাজস্বের প্রায় অর্ধেক নেওয়া হয় প্রত্যক্ষ কর থেকে। উন্নত দেশগুলোতে মোট রাজস্বের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ সংগ্রহ করা হয় প্রত্যক্ষ কর থেকে। আমাদের আয় ও সম্পদ বৈষম্য কমাতে চাইলে প্রত্যক্ষ করের ওপরেই বেশি জোর দিতে হবে।

লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে কত? :
২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য সাত লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি ব্যয় বরাদ্দের লক্ষ্য ধরে প্রস্তাবিত বাজেট তৈরির কাঁটছাট চলছে বলে কর্মকর্তার জানিয়েছেন। এতে মোট পাঁচ লাখ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের মধ্যে এনবিআরের মাধ্যমে সোয়া চার লাখ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরে হিসাব কষছেন কর্মকর্তারা।

এর মধ্যে আগামী বাজেটে যোগান দেওয়ার জন্য মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) খাত থেকে সবচেয়ে বেশি প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা বা ৩৭ শতাংশ রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করতে চায় সরকার।

পরোক্ষ করের আরেক খাত শুল্ক (আমদানি শুল্ক) থেকে আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা বা মোট লক্ষ্যমাত্রার ২৭ শতাংশ।

অর্থাৎ পরোক্ষ করের প্রধান এ দুই খাত থেকে ২ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা আহরণের লক্ষ্য ধরে বাজেটের হিসাব মেলোনোর কাজ চলছে।

চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রায় পরোক্ষ করের অংশ ছিলো প্রায় ৬৭ শতাংশ। এবার তা কিছুটা কমিয়ে ৬৪ শতাংশে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে কর্মকর্তারা জানান।

অপরদিকে নতুন বাজেটে রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রার প্রস্তাবে প্রত্যক্ষ কর থেকে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কিছুটা বাড়িয়ে প্রায় ৩৬ শতাংশ বা প্রায় ১ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি হতে পারে। চলতি অর্থবছরে যা ছিল লক্ষ্যমাত্রার ৩৩ শতাংশ বা ১ লাখ ২২ হাজার ১০০ কোটি টাকা।

সবশেষ তথ্য অনুযায়ী চলতি অর্থবছরের এ পর্যন্ত টিআইএনধারীর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৮৮ লাখ। এরমধ্যে রিটার্ন দাখিল হয়েছে মাত্র ৩২ লাখ। এদের মধ্যে আয়কর দাতার সংখ্যা আরও কম।

অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমানের মতে, দেশের যেসব মানুষ প্রত্যক্ষ কর দিতে সামর্থবান কিন্তু দিচ্ছে না কিংবা যারা ফাঁকি দিচ্ছেন তাদের চিহ্নিত করে করের আওতায় এনে রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর নীতি গ্রহণ করতে হবে।

এজন্য কর আহরণ ব্যবস্থাকে আরও ডিজিটাল করা এবং দুর্নীতি কমাতে নজর দেওয়ার সময় এসেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলছেন, সরকার রাজস্ব আহরণ বাড়ানো এবং বৈষম্য কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে।

এবারও প্রত্যক্ষ কর থেকে বেশি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার বিষয়ে তিনি বলেন, অনেক দিন ধরেই আমাদের রাজস্ব আহরণের প্রধান খাত ভ্যাট। একদিকে আমাদের রাজস্ব বাড়াতে হবে। আবার অন্যদিকে বৈষম্যও কমাতে হবে। তাই আমরা চলতি অর্থবছরে প্রত্যক্ষ করের অংশ অন্যান্য অর্থবছরের তুলনায় বাড়িয়েছি। আগামী বাজেটে প্রত্যক্ষ করের অংশ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়াতে না পারলেও অংশ বাড়তে পারে। আগামী বাজেটগুলোতে বৈষম্য কমানোর উদ্যোগ হিসেবে অবশ্যই প্রত্যক্ষ করের অংশ বাড়বে।

আইএমএফের পরামর্শও পাচ্ছে গুরুত্ব :
আগামী অর্থবছরে এনবিআরের মাধ্যমে সোয়া চার লাখ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে প্রস্তাবিত বাজেটের আয় ব্যয়ের হিসাব নিকাশ চলছে, যা চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ১৬ দশমিক ২ শতাংশ বেশি।

পরিকল্পনায় থাকা এ লক্ষ্যমাত্রা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৮ দশমিক ৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে বাজেটে নির্ধারিত রাজস্ব আহরণে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা জিডিপির ৮ দশমিক ৩ শতাংশ।

সরকারি হিসাবে দেশে বর্তমানে কর-জিডিপি অনুপাত ৭ দশমিক ৮ শতাংশ; যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম। নেপালে যা ২৩ দশমিক ৩, ভারতে ২০ দশমিক ৩, পাকিস্তানে ১৫ দশমিক ২ ও শ্রীলঙ্কায় ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ।

অর্থনীতিবিদরা দীর্ঘদিন থেকে জিডিপি ও রাজস্ব আয়ের অনুপাত বাড়াতে অধিক জোর দেওয়ার কথা বলে আসছেন।

বিদেশি মুদ্রার চাপে থাকার মধ্যে বাংলাদেশ ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ চাইলে তা অনুমোদনের আগে সমঝোতায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) প্রতিবছর জিডিপির অনুপাতে শুন্য দশমিক ৫ শতাংশ হারে লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে। এ লক্ষ্য ধরে এগোতে সম্মতি দিয়েছে বাংলাদেশও।

এ শর্তপূরণের প্রথম বাজেটে রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রা জিডিপির অনুপাতে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব তৈরি করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন এনবিআরের এক কর্মকর্তা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, সম্প্রতি দেশে ধনী-গরীবের আয় বৈষম্য নিয়ে যে সমালোচনা হচ্ছে তা দূর করার বিষয়টি মাথায় নিয়ে এবার লক্ষ্যমাত্রা সাজানো হয়েছে। আগামী অর্থবছরে প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর দিকে কিছুটা হলেও মনোযোগ থাকছে।

আইএমএফের সুপারিশ আমলেই নিয়ে রাজস্ব আহরণের হিসাব করার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, তবে ইউক্রেইন যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে খারাপ সময় যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে আমাদের আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যে। যুদ্ধ আগামী অর্থবছরও কতটা প্রভাব ফেলবে তা এখনই বলা মুশকিল। এমন এক পরিবেশে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে খুব বেশি চাপ তৈরি করতে চায় না সরকার।

বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত কম হওয়ার বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, সরকার নতুন বাজেটের জন্য রাজস্ব আহরণের যে লক্ষ্যমাত্রা নিচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে তাতে কর-জিডিপির হারে তেমন প্রভাব ফেলছে না। এক্ষেত্রে পিছিয়েই থাকলাম।

এখন আয়কর, ভ্যাট ও শুল্কের প্রতিটি থেকে প্রায় এক তৃতীয়াংশ করে রাজস্ব আসছে জানিয়ে তিনি বলেন, জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আয়ে উন্নতি করতে অবশ্যই প্রত্যক্ষ করে জোর দিতে হবে।

অর্থনীতির এ গবেষক বলেন, দেশে এখন প্রতিদিন ধনীর সংখ্যা বাড়ছে। তাঁদের কাছ থেকে সম্পদ কর নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সার্বিকভাবে রাজস্ব আহরণ বাড়াতে সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে রাজস্ব আহরণ একটা সম্মানজনক অবস্থায় নেওয়া যেতে পারে।