প্রধানমন্ত্রী : উপযুক্ত জায়গা বাংলাদেশ, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের খুঁজে নিন

প্রধানমন্ত্রী : উপযুক্ত জায়গা বাংলাদেশ, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের খুঁজে নিন

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ ও ডন : বিদেশি বিনিয়োগকারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, উইন-উইন পরিস্থিতির জন্য ব্যবসার সুবিধার্থে বিনিয়োগ এবং সোর্সিংয়ের জন্য বাংলাদেশকে বেছে নিন। বিনিয়োগের সব থেকে উপযুক্ত জায়গা বাংলাদেশ। একইসঙ্গে দেশের ব্যবসায়ীদেরও বিদেশি পার্টনার খুঁজে তাঁদের প্রযুক্তিগতজ্ঞান আমাদের শিল্পখাতে ব্যবহার করার পরামর্শ দেন তিনি।

আজ রোববার (১৩ নভেম্বর) সকালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) আয়োজিত ‘মেইড ইন বাংলাদেশ উইক’ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।

১৫ আগস্টের বিয়োগান্তক ঘটনা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতির পিতার সারা জীবনের সাধনা ছিলো বাঙালির শিক্ষা-দীক্ষাসহ সবদিক থেকে উন্নত জীবন পাবে। একটি মর্যাদাপূর্ণ জাতি হিসেবে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে এসেছিলাম একটি প্রত্যয় নিয়ে যে, দেশ আমার স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন জাতির পিতা, সেই দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করবো, এ দেশকে উন্নত করবো।’

‘জিডিপিতে গার্মেন্টস সব থেকে বেশি অবদান রেখে যাচ্ছে’ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের সরকার সব সময় রপ্তানি খাতকে গুরুত্ব দেয়। এই খাত যেনো আরও প্রবৃদ্ধি অর্জন করে, আরও প্রসারিত হয়— সেজন্য পণ্য ও সেবাকে দীর্ঘমেয়াদি কর প্রণোদনা প্রদান করি। একইসঙ্গে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ডকে গ্লোবাল ব্র্যান্ডে পরিণত করার লক্ষ্যে রপ্তানির নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি এবং পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ করে বাজার তৈরির উদ্যোগকে উৎসাহিত করছি। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে কর হার সাধারণ কারখানার জন্য ১২ শতাংশ এবং গ্রিন কারখানার জন্য ১০ শতাংশ করা হয়েছে। ফলে আজ বিশ্বসেরা ১০টি পরিবেশবান্ধব কারখানার মধ্যে ৯টিই বাংলাদেশের।’

সুযোগ বা প্রণোদনা অনেককেই দেওয়া হয়। কিন্তু কাজে লাগাতে পারে না। কিন্তু গার্মেন্টস তা কাজে লাগিয়েছে। সেজন্য গার্মেন্ট খাতের সংশ্লিষ্টদের প্রতি আন্তরিক ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘করোনা মহামারি সারা বিশ্বের অর্থনীতিকে স্থবির করে দিয়েছিলো। যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের ব্যবসায়ীরা অনেক উদ্বিগ্ন ছিলেন। সেই সময় আওয়ামী লীগ সরকার পদক্ষেপ নেয়, বিশেষ আর্থিক প্রণোদনা ও নীতি সহায়তা দিয়েছিলাম। ফলে অত্যন্ত সফলভাবে করোনা মহামারি মোকাবিলা করতে পেরেছি।’

‘প্রণোদনা প্যাকেজের মাধ্যমে আমাদের শিল্পের মালিক-শ্রমিক সকলেই যেনো একটা সুষ্ঠুভাবে কার্যক্রম চালাতে পারে, সেই ব্যবস্থা করেছি। প্রণোদনা প্যাকেজের সঙ্গে যে অর্থ দিয়েছে, তার সুদের হার কমিয়ে সেখানে ভতুর্কি দিয়েছি। রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য রিজার্ভ থেকে বিশেষ তহবিল গঠন করে দিয়েছি,’ বলেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি আরও বলেন, ‘রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বিশেষ তহবিল, ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধা প্রদান, ক্ষুদ্র (কুটির শিল্পসহ) ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধা প্রদান এবং রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা শিল্পের দুঃস্থ শ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমসহ মোট ২৮টি প্যাকেজের আওতায় স্বল্প সুদে ২ দশমিক ৩৭ ট্রিলিয়ন টাকার ঋণ বরাদ্দ প্রদান করেছি। যা ২০২২ অর্থবছরর মোট জিডিপির ৫ দশমিক ৯৮ শতাংশ। সময়োচিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করেছিলাম বলেই তার শুভফল পাচ্ছে সবাই। সকল বাধা অতিক্রম করে আপনারা ব্যবসা চালাতে পাাচ্ছেন।’

২০৩০ সাল নগাদ ১ শ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি মাইলস্টোন বিজিএমইএ কর্তৃক নির্ধারণ করা হয়েছে। এই লক্ষ্য অর্জনে সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করতে হবে এবং সেগুলো কাটিয়ে উঠার দক্ষতাও অর্জন করতে হবে। শুধু ঘোষণা দিলেই হবে না। কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে বলেও উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা কিন্তু এখন উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছি। এ কারণে হয়তো এলডিসি হিসেবে যে সকল সুবিধা পাই, তা হয়তো কিছুটা কমবে। তবে ভালো কথা হলো ২০২৪ সালে আমাদের এলডিসি গ্রাজুয়েশন কার্যকর করার কথা। আমরা ২০২৬ পর্যন্ত দুই বছর সময় নিয়েছি।’

‘এ ছাড়া ২০২৯ পর্যন্ত আমাদের হাতে সময় আছে। এর মধ্যে সমস্ত প্রস্তুতি নিতে হবে, উন্নয়নশীল দেশের ব্যবসায়ী হিসেবে হয়তো কিছুক্ষেত্রে আমরা সুবিধা পাবো না। কিন্তু এর থেকে অনেক বেশি বেশি সুবিধা আমরা পেতে পারবো উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে। সেটাও আমাদের মনে রাখতে হবে।’

‘বাংলাদেশের জনগণই হচ্ছে আমাদের সাহসের উৎস’ জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘শুধু রপ্তানি করবো তা না, আমাদের নিজ দেশের ভিতরেও বাজার সৃষ্টি করতে হবে। দেশের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়াতে হবে। এজন্য করোনাকালীন সময় তৃণমূল পর্যায়ে যতো বেশি অর্থ বরাদ্দ করা দরকার, তা করেছি। তাতে মানুষের ভিতর হাহাকার আসে নি।’

‘যাঁরা শ্রম দেয়, তাঁরা এই দেশেরেই মানুষ’ জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘শ্রমিকদের আরও উন্নত ট্রেনিং দিতে চাই। কারণ বিশ্ব এখন বিজ্ঞানের কারণে প্রযুক্তির নতুন নতুন আবির্ভাবের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কাজেই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে হবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের পদধ্বনি শুনছি। কাজেই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে উপযুক্ত দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হবে। এজন্য ইতোমধ্যেই পদক্ষেপ নিয়েছি। নতুন উদ্যোক্তাও সৃষ্টি করছি। কাজেই চতুর্থ শিল্প বিপ্লব আমাদের অর্থনীতি এবং কর্মসংস্থানে যে প্রভাব ফেলবে, তার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে কাজ করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘তৈরি পোশাক শিল্পে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন রোবট, প্রযুক্তি ব্যবহার ও আর্টিফিশিয়াল টেকনোলজিসহ সব বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। সেজন্য কিন্তু আমরা প্রস্তুত। আমাদের মানুষের ভিতর এই চিন্তা ঢোকাতে হবে। একইসঙ্গে দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য দক্ষ শ্রমিকের দরকার।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে শ্রম বাজারে যে ধরনের পরিবর্তন আসবে, তার জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। যেনো আমরা কাজ করতে পারি।’ 

শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের প্রতি শ্রমিকদের ভালোমন্দ ও শ্রমিকদের কল্যাণ নিশ্চিত করাসহ মানসম্মত পরিবেশে কাজ করার জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের সাড়ে ষোল কোটির উপরে মানুষ। তাঁদের খাদ্য নিরাপত্তা দিতে হবে। আমরা কারও কাছে ভিক্ষা করতে না, নিজের উৎপাদন নিজে করবো। সেজন্য ফসলি জমি রক্ষার করা, যত্রতত্র শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে না তোলার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।’

তাঁর সরকারের মেয়াদে যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি করা হয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এটা শুধু আমাদের বাংলাদেশ না। পাশাপাশি সাউথ এশিয়া ও সাউথ ইস্ট এশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার সৃষ্টি করেছে। এই অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠী রয়েছে— এটাও কিন্তু একটা মার্কেট। এক্ষেত্রে আবার চ্যালেঞ্জও রয়েছে সেটাও সবাইকে মনে রাখতে হবে।’

দেশের ১ শটি অর্থনৈতিক অঞ্চলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের নীতিমালা হচ্ছে বিনিয়োগবান্ধব। একইসঙ্গে আমাদের দেশের শুল্কমুক্ত কোটা বিনিয়োগকারীদেরও আকর্ষণ করছে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে, ট্রান্স এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে।’ 

‘তা ছাড়া ওয়াটারওয়েজ, এয়ারওয়েজ ও রেল— সবকিছুতেই আমরা উন্নয়ন করে যাচ্ছি। কারণ এই অঞ্চলে বিশাল মার্কেট, সেটা সবাইকে মাথায় রাখতে হবে।’

করোনাসহ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, পাল্টা নিষধাজ্ঞার কারণে বর্তমান বৈশ্বিক সঙ্কটের কঠিন পরিস্থিতির প্রসঙ্গ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যুদ্ধ বন্ধ হোক, সেটা আমরা চাই। এই নিষধাজ্ঞা এবং পাল্টা নিষেধাজ্ঞা বন্ধ হোক। সহজভাবে প্রত্যেকটা দেশের মানুষ যেনো ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারে, আমরা সেটাই চাই।’

‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ উইকে অনুষ্ঠিত সংলাপগুলো একটি উন্নত বাংলাদেশ গড়ার পথে আমাদের আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে বলেও মনে করেন প্রধানমন্ত্রী।

অনুষ্ঠানে পোশাক রপ্তানিতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ চারজন তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারককে বিশেষ সম্মাননাও প্রদান করেন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, ইন্টারন্যাশনাল অ্যাপারেল ফেডারেশন (আইএএইফ) সভাপতি সেম অলটান এবং বিজিএমইএ’র সভাপতি ফারুক হাসান এবং সিনিয়র সহ-সভাপতি এস এম মান্নান কচি বক্তব্য দেন।