ডন প্রতিবেদন : বাসে আমার পাশে বসার পর লোকটাকে দুবার বলেছিলাম হাত গুছিয়ে বসেন। তখন দুবারই সরি বলেন। আমি মাথাব্যথার জন্য জানালায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে ছিলাম। টের পেলাম আমার শরীরে তাঁর হাত। ‘টি–শার্ট ধরে টান দিয়ে দাঁড় করিয়ে বললাম, তুই গায়ে হাত দিলি ক্যান?
লোকটা বলে, কী আশ্চর্য! আপনি তো ঘুমাই ছিলেন। চট করে মাথায় রক্ত উঠে যায়। আমি ঘুমিয়ে থাকলেই সে আমার গায়ে হাত দিতে পারে? তারপর নিজের কান ধরে; আমার ও আমার মায়ের পা ধরে মাফ চেয়ে বাস থেকে নেমে যায়।
কথাগুলো রাজধানীর একটি কলেজের ছাত্রী কাজী জেবুননেসা কামালের। রবিবার (১৩ মার্চ) সন্ধ্যার পর মৌমিতা পরিবহনের একটি বাসে পাশে বসা এক লোক তাঁর গায়ে হাত দিলে এভাবেই প্রতিবাদ করেন তিনি। জেবুননেসার ক্ষোভ, বাসের একজন পুরুষ যাত্রীও এ ঘটনার প্রতিবাদে এগিয়ে আসেন নি। উল্টো বলেছেন, লোকটি যেহেতু ভুল স্বীকার করে মাফ চাইছে, তাই তাঁকে ক্ষমা করে দেওয়াই ভালো।
এ প্রতিবাদের সামান্য অংশ ভিডিও করতে পেরেছিলেন বাসের আরেক নারী যাত্রী। সেটি জেবুননেসাকে ফেসবুকে শেয়ার করতে বলেছিলেন তিনি। গত রাতে জেবুননেসা ভিডিওটি তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্টে শেয়ার করেন। ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে এটি। রবিবার রাত সাড়ে আটটা থেকে সোমবার বিকেল পৌনে পাঁচটা পর্যন্ত শেয়ার করা পোস্টটিতে ২২ হাজার মানুষ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। এটি ৪ লাখ ৫৮ হাজার বারের বেশি ভিউ হয়েছে। পোস্টটি শেয়ার করেছেন ৭ হাজার ৪০০ জন।
রাজধানীর শনির আখড়া থেকে জেবুননেসা ও তাঁর মা হালিমা খানম বাসটিতে চড়ে যাচ্ছিলেন কল্যাণপুর। আজিমপুরের কাছাকাছি বাসটি আসার পর ওই ঘটনা ঘটে। আসন খালি না থাকায় বাসচালকের পাশে ইঞ্জিনের কাছে জেবুননেসা দাঁড়িয়ে ছিলেন। পরে আসন পান। কিছুক্ষণ পর পাশের আসনে বসেন লোকটি।
সোমবার মুঠোফোনে কথা হয় জেবুননেসা ও তাঁর মায়ের সঙ্গে। জেবুননেসা বলেন, ‘নিয়মিত বাসে চড়ি। আগেও দু-একজনকে অসভ্যতা করার জন্য চড়–থাপ্পড় দিয়েছি। তবে সেগুলোর ভিডিও নেই। গতকালও কেউ ভিডিও করবে বা করছে কি না, মাথায় ছিল না। আমি ভাইরাল হওয়ার জন্য কিছু করিনি। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে আমি প্রতিবাদ না করে থাকতে পারি না।’
জেবুননেসা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বাসের কয়েকজন ছেলে যাত্রী নাকি মিটমিট করে হেসে বলছিলেন, তাঁরা পুরো ঘটনার ভিডিও করেছেন। শব্দ বন্ধ করে বা মিউট করে তাতে অন্য কিছু বসিয়ে ফেসবুকে ছেড়ে দিলেই ভাইরাল হয়ে যাবে। ঘটনার কিছুক্ষণ আগে বাসে ওঠা আরেক নারী কথাগুলো শুনে মুঠোফোনে ঘটনার সামান্য অংশ ভিডিও করেন প্রমাণ রাখতে। মেসেঞ্জারে ওই ভিডিও জেবুননেসাকে দিলে সেটি শেয়ার করা হয়।
প্রথম থেকেই ওই লোককে স্বাভাবিকভাবে বসতে বলেছিলেন জেবুননেসা। বাসের অন্যরা যেন শুনতে পায়, সে জন্য একটু জোরেই কথাগুলো বলেছিলেন। ঘটনার সময় কয়েকজন নারী যাত্রী সে কথাই বলছিলেন যে লোকটিকে আগেই সাবধান হতে বলা হয়েছিল। তবে বাসচালক ও তাঁর সহযোগী এবং পুরুষ যাত্রীরা পুরো ঘটনা বসে বসে দেখেন। লোকটিকে এভাবে মারা ঠিক হচ্ছে না বা ভিডিও করলে তাঁর পরিবারের সমস্যা হবে—এ ধরনের উপদেশও দিচ্ছিলেন কেউ কেউ। একপর্যায়ে লোকটিকে ক্ষমা চেয়ে বাস থেকে নেমে যাওয়ার পরামর্শ দেন পুরুষ যাত্রীরা।
জেবুননেসা বলেন, ‘লোকটিকে ধরতে বা তাঁর মুঠোফোন নম্বর জানার জন্য অনুরোধ করা হলেও কেউ এগিয়ে আসেননি। মা এসে প্রতিবাদ করেন। যাত্রীরা এগিয়ে আসেননি বলেই লোকটি বাস থেকে নেমে যাওয়ার সুযোগ পান। নামার আগে মারতে মারতে লোকটির টি–শার্ট ছিঁড়ে ফেলেছিলাম। যাত্রীরা আইন যাতে নিজের হাতে তুলে না নিই, লোকটিকে যাতে পুলিশে দিই ইত্যাদি বলতে থাকেন। আরে, আমি বাসের মধ্যে পুলিশ কোথায় পাব?’
‘থাপ্পড় খাওয়ার পর লোকটি বলতে থাকেন তাঁর ভুল হয়েছে। এরপরও কেউ এগিয়ে এলেন না?’—ক্ষুব্ধ হয়ে বলছিলেন জেবুননেসা। বলেন, ‘৩৫–৪০ বছর বয়সী লোকটির আচরণ সহ্য করতে পারিনি বলেই গায়ে হাত তুলতে বাধ্য হয়েছি। কিন্তু একা আর কতক্ষণ আটকে রাখতে পারি? বাসে অন্য যাত্রী আছে, লাইট জ্বালানো আছে, তারপরও লোকটি সাহস পায় ক্যামনে?’
জেবুননেসা বলেন, এ ধরনের ঘটনার প্রতিবাদ করা উচিত মনে করেছেন বলেই তিনি তা করেছেন। এতে তিনি ভয় পান না। গণমাধ্যমে নাম–পরিচয় প্রকাশ পেলেও তাঁর কোনো আপত্তি নেই। কেননা এ ধরনের প্রতিবাদে তাঁর ব্যবসায়ী বাবা, বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া বড় ভাই, মামা, নানু, বন্ধু-স্বজনেরা সব সময়ই পাশে থাকেন। তবে নিজের যাতে কোনো বিপদ না হয়, সে জন্য কিছুটা সাবধানও থাকতে বলেন। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতেও বেশির ভাগ মানুষ প্রতিবাদ করায় সাধুবাদ জানিয়েছেন। কেউ কেউ খারাপ মন্তব্য করেছেন। বলেছেন, বাসে এ ধরনের ঘটনা ঘটবে জানা কথা, বাবার গাড়িতে চড়ে যাতায়াত করলেই তো হয়।
বিকেলে কথা হয় হালিমা খানমের সঙ্গে। তিনি জানালেন, শনির আখড়ায় ভাইয়ের বাসায় গিয়েছিলেন; সঙ্গে ছেলেও ছিল। তবে কাজ থাকায় ছেলে আগেই চলে এসেছিল। পরে মেয়েকে নিয়ে বাসায় ফিরছিলেন। মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য হিসেবে বাসে চড়ার তেমন বিকল্পও নেই।
হালিমা খানম বলেন, ‘ইঞ্জিনের পাশে মেয়ে আমাকে বসিয়ে দেয়। মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি খেয়াল রাখছিলাম। কিছুক্ষণ পর মেয়ে সিট পায়। তার পাশে এক লোক বসে। এ নিয়ে আমি মাথা ঘামাইনি। মেয়ে নিজেকে কীভাবে নিরাপদ রাখতে হয় জানে। মেয়ের চিৎকার শুনে মেয়ের সিটের কাছে যাই। মেয়ে বারবার লোকটিকে বলছিল, “তুই গায়ে হাত দিলি ক্যান?” ততক্ষণে লোকটি আমার মেয়েকে মামণি সম্বোধন করে ক্ষমা চাওয়া শুরু করেছে। তখন আমিও বলি পা ধরে ক্ষমা চাইতে।’
‘আমি আমার মেয়েকে বিশ্বাস করি। লোকটি অন্যায় না করলে মেয়ে এমন করত না। বারবার লোকটি মেয়ের গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা করছে, তারপর মেয়ে ঘুমিয়ে গেছে ভেবে গায়ে হাত দেয়। আমিও মনে করি, এ ধরনের ঘটনার প্রতিবাদ করা উচিত। আমিও প্রতিবাদ করি, তবে মেয়ের মতো অতটা সাহস আমার নেই। অন্য কারও সঙ্গে অন্যায় হচ্ছে বা কুকুর–বিড়ালের সঙ্গে কেউ অন্যায় করলেও মেয়ে প্রতিবাদ করে। আমি জানি, এতে মেয়ে বিপদে পড়তে পারে। কিন্তু তা ভেবে তো লাভ নেই। আমি জানি, মেয়ে ভবিষ্যতেও এমন ঘটনা ঘটলে প্রতিবাদ করবে।’ বলছিলেন জেবুননেসার মা।
মা যখন কথা বলছিলেন, পাশ থেকে মেয়ে জেবুননেসা মুঠোফোন নিয়ে বললেন, ‘সমাজের লোকজন মেয়েদের খারাপ বলে, কিন্তু কোনো মেয়ে যখন প্রতিবাদ করে, তখন সমাজের মানুষগুলো আর এগিয়ে আসে না। তাই সমালোচনা যা–ই হোক, প্রতিবাদ করতেই হবে। গতকালের ঘটনার ভিডিও ফুটেজ আছে বলে লোকটি তাঁর পরিবারের কাছে গিয়ে আর মিথ্যা বলতে পারবেন না। না হলে বাড়ি ফিরে হয়তো বলতে পারতেন, ছিনতাইকারী ধরেছিল বলে তাঁর এ হাল হয়েছে।’