জালিয়াতির ‘গডফাদার’ অগ্রণীর শামস্‌-উল

জালিয়াতির ‘গডফাদার’ অগ্রণীর শামস্‌-উল

নিজস্ব প্রতিবেদক, বাঙলার কাগজ ও ডন; রাহাতুল রাফি : রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক খাতের অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডের সদ্য সাবেক হওয়া ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ শামস্‌-উল ইসলাম এতোই জালিয়াতি করেছেন যে, ব্যাংকটিতে বর্তমানে বুদবুদের সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর জালিয়াতির কারণে অনেক ক্ষতি হয়েছে রাষ্ট্রের। আর কমিশন নেওয়ার মাধ্যমে শামস্‌-উল যেসব ঋণ দিয়েছেন, সেগুলো শিগগিরই খেলাপি হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর এসব ঋণ খেলাপি হয়ে পড়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকে বিপুল পরিমাণে প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) সংরক্ষণ করতে হবে এ ব্যাংককে। এতে স্বাভাবিকভাবে মুনাফা কমে যাবে অগ্রণী ব্যাংকের। মোহাম্মদ শামস্‌-উল এমন একজন ব্যক্তি ছিলেন, যার আমলে ব্যাংকটির প্রায় এমন কোনও খাত নেই, যেখানে জালিয়াতি হয় নি, আর তাতে শামস্‌-উল অংশগ্রহণ করেন নি। মোহাম্মদ শামস্‌-উলের আমলে কাগুজে মুনাফা দেখানো, মর্টগেজ নেওয়ার নামে অনিয়ম, শাখা পর্যায়ে ব্যাপক হারে ঋণ জালিয়াতি, গরীব ও অসহায় কৃষকের আইডি কার্ড ব্যবহার করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া, দুদকে ব্যাংকটির পক্ষ থেকে জালিয়াতি থেকে মুক্তি পেতে ভুয়া সুপারিশ পাঠানো, কৃষকের নামে ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ, ডাটা অ্যান্ট্রি অপারেটরের মাধ্যমে জালিয়াতি করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া, ভুয়া কাগুজে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অর্থ জালিয়াতি-অর্থ আত্মসাৎ এবং অর্থ পাচার, চেক জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার মতো বড় ধরনের জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে অগ্রণী ব্যাংকে। দুই মেয়াদে মোহাম্মদ শামস্‌-উল যখন অগ্রণী ব্যাংকে ৬ বছর ধরে এমডি ছিলেন, তখন এসব জালিয়াতি ব্যাংকটিতে হয়েছে। যেখানে ব্যাংক-কোম্পানি আইন অনুযায়ী ব্যাংকটির সাবেক এমডি ও সিইও এসব জাল-জালিয়াতির দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না।

অনিয়ম ও জাল-জালিয়াতির অভিযোগের ব্যাপারে জানার জন্য বুধবার (১২ এপ্রিল) অগ্রণী ব্যাংকের সদ্য সাবেক হওয়া ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শামস্‌-উল ইসলামের মুঠোফোনে আগেই খুদেবার্তা পাঠানো হয়। এরপর আরও কিছুক্ষণ পর ফোন দেওয়া হয়। কিন্তু ফোন রিসিভ করেন নি তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, অগ্রণী ব্যাংক এক অভিনব জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে নিজেদের বন্ধকি জমির অস্তিত্ব খুঁজে না পেয়ে নামের মিলের কারণে রাজধানীর দক্ষিণ গোড়ান, খিলগাঁওয়ে অন্যের জমি ও বাড়ি নিলামে বিক্রি করে দিয়েছে। অগ্রণী ব্যাংকের নবাবপুর শাখা অভিনব এই জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে। এই জালিয়াতি বাস্তবায়নে অংশীদার হয়েছেন ৮২ নং নবাবপুর রোড, ওয়ারীর বাসিন্দা মৃত আলী আহমেদ এর পুত্র বহুল আলোচিত রিয়াজ আহমেদ।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ব্যাংকের এই শাখা থেকে ঋণ নিতে মেসার্স ট্রেড ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড যে ছয়টি জমি বন্ধক রেখেছিলো, তার একটি মো. আবু বকর সিদ্দিকী ওরফে সিদ্দিকুর রহমানের। ১৬ বছরের আইনি লড়াইয়ে জিতে অগ্রণী ব্যাংক আবু বকর সিদ্দিকীর ৬০৬ খিলগাঁও এর ৬ দশমিক ৬ শতাংশ জমির বদলে ৩২২/১ দক্ষিণ গোড়ান, খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা আবু বকর সিদ্দিকের ৩ দশমিক ৩ শতাংশ জমির উপর নির্মিত চারতলা বাড়ি নিলামে তুলে বেচে দিয়েছে। ব্যাংক বলছে, তাঁদের কোনও দোষ নেই। সব দোষ নিলামে ওঠা বাড়ির মালিক আর নিলাম ক্রেতার। অন্যদিকে বাড়ির মালিক আর ক্রেতা দুষছেন ব্যাংককে। উল্লেখ্য এই একই ক্রেতা সম্প্রতি ৩৬/২ কাকরাইলের এক মুক্তিযোদ্ধার বিধবা স্ত্রীর আড়াই কাঠা জমির উপর নিমিত ৬ তলা ভবন ভুয়া নিলাম জালিয়াতির মাধ্যমে ক্রয় করে দখলে নিয়েছেন। জালিয়াতির বিষয় হাইকোর্টে প্রমাণিত হওয়ায় হাইকোর্ট নিলাম বাতিল করেছেন। হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে নিলামক্রেতা সুপ্রিমকোর্টে আপিল করে দখলদারিত্ব বজায় রেখেছেন।

ভুক্তভোগী ৩২২/১ দক্ষিণ গোড়ান, খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা আবু বকর সিদ্দিক আদালতে অভিযোগ দায়ের করে লিখেছেন, আদালতকে অন্ধকারে রেখে ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তা, নিলাম ক্রেতা ও আদালতের নিয়োগ করা বেইলিফ (জারিকারক) বদমতলবে এই কাজ করেছেন। নিলামে বাড়ি ও জমিটি কিনেছেন ৮২ নং নবাবপুর রোড, ওয়ারীর বাসিন্দা রিয়াজ আহমেদ, পিতা-মৃত আলী আহমেদ। তিনি বলেন, তিনি টাকা দিয়েছেন। জমি বুঝিয়ে দেওয়া ব্যাংকের কাজ। তিনি এর দায় নেবেন কেনো?

ঘটনাস্থলে গিয়ে এবং ব্যাংক, ভূমি নিবন্ধন অফিস ও সিটি করপোরেশনের কাগজপত্র যাচাই করে দেখা গেছে, আবু বকর সিদ্দিক ব্যাংকের ভুলের শিকার হয়েছেন। কিন্তু এর মধ্যেই গত ৯ ডিসেম্বর আদালতের প্রতিনিধি, নিলাম ক্রেতা, পুলিশ এবং মাথায় লাল ফিতা বাঁধা শতাধিক শ্রমিক আবু বকর সিদ্দিকের বাসার দখল নেন। ভাড়াটেদের জোর করে বের করে দেন ও ভাঙচুর চালান। আশপাশের লোকজনের বাধায় পরে তাঁরা চলে যান।

আবু বকর সিদ্দিক বলেন, তিনি ৩৫ বছর সৌদি আরবে ছিলেন। সম্পদ বলতে চারতলা এই বাড়ি। দেশে ফিরে এই বাড়ির ভাড়া দিয়েই সংসার চালান। চারতলা বাড়ির ছয়টি ফ্ল্যাটে ভাড়াটে ছিলো। বিনা নোটিশে তাঁদের বের করে দেওয়া হয়। ওই সময় তিনি বরিশালে ছিলেন।

গোলমালটা কোথায়? : খুঁজতে ঘটনার শিকার ব্যক্তি, ব্যাংক, ভূমি অফিস, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, জাতীয় পরিচয়পত্র অনুবিভাগ ও ট্রেড ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের মালিকদের সঙ্গে কথা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি এখন রুগ্ন। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুর রহিম নিজেই নিশ্চিত করেছেন, ৩২২/১ দক্ষিণ গোড়ান, খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা এই আবু বকর সিদ্দিকের কোনও জমি তাঁদের প্রতিষ্ঠানে বন্ধক ছিলো না। ছিলো ৬০৬ খিলগাঁও এর আবু বকর সিদ্দিকী ওরফে সিদ্দিকুর রহমানের ৬ দশমিক ৬ শতাংশ জমি। ২৪ থেকে ২৫ বছর ধরে তিনি ওই ব্যক্তিকে খুঁজে পাচ্ছেন না।

ব্যাংক অবশ্য দায় স্বীকার করতে চাইছে না।

এ ব্যাপারে অগ্রণী ব্যাংকের নবাবপুর শাখার ওই সময়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক শেখ মনিরুল ইসলাম এর আগে বাঙলার কাগজ ও ডনকে বলেন, ১৯৯২ সালে মেসার্স ট্রেড ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডকে ঋণ দেওয়ার সময় তৎকালীন শাখা ব্যবস্থাপক মো. রুহুল আমিন ও সুবীর কুমার চক্রবর্তী যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে তাঁরা অবসরপ্রাপ্ত এবং তাঁদের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই। নথিপত্র দেখে মনে হয়েছে, তাঁরা জমি দেখেই ঋণ দিয়েছেন।

ঝিনাইদহের এক শাখা থেকেই প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ টাকার ঋণ জালিয়াতি : ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলায় অগ্রণী ব্যাংকের প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ টাকার ঋণ জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে।

অগ্রণী ব্যাংকের অডিট অ্যান্ড ইন্সপেকশন ডিভিশন ১-এর ২৬তম অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে সংশ্লিষ্টদের দোষী সাব্যস্ত করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। তবে সর্বশেষ খবর পর্যন্ত অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনও মামলা করা হয় নি।

অগ্রণী ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ২৩৮ পৃষ্ঠার ওই তদন্ত প্রতিবেদনে কালীগঞ্জ অগ্রণী ব্যাংকের শাখার লুটপাটের ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে।

জানা গেছে, অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক এমডি মোহাম্মদ শামস্‌-উল ইসলামের সময়ে ২০২০ সালের অক্টোবরে কালীগঞ্জ অগ্রণী ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট অভিযুক্তদের বিদেশগমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।

কৃষকদের নাম করে ঋণ জালিয়াতি ও নথি পোড়ানো : গরীব ও অসহায় কৃষকদের আইডি কার্ড ব্যবহার করে কৃষি ঋণের নামে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয় ঋণ জালিয়াতির প্রমাণ লোপাটে নথিপত্রে পুড়িয়ে ছাই করা হয়েছে। শেরপুরে অগ্রণী ব্যাংকের নালিতাবাড়ী শাখায় ঘটেছে এমন আজব ঘটনা। এক্ষেত্রে অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক এমডির যোগসূত্র ছিলো বলে দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।