চবিতে যৌন নিপীড়ন : ছাত্রলীগের সমর্থক আজিমসহ র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার ৪।

চবিতে যৌন নিপীড়ন : ছাত্রলীগের সমর্থক আজিমসহ র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার ৪।

নিজস্ব সংবাদদাতা, বাঙলা কাগজ; চট্টগ্রাম : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) শিক্ষার্থীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন ৪ যুবক। তাঁরা নিজেদের ছাত্রলীগের কর্মী বলে দাবি করেছেন।

তাঁদের গ্রেপ্তারের পর সংবাদ সম্মেলনে আসা র‌্যাব কর্মকর্তারা এই তথ্য জানিয়েছেন।

তবে ছাত্রলীগে তাঁদের কোনও পদ নেই বলেই তাঁদের সংগঠনটির কর্মী হিসেবে তুলে ধরতে চান নি র‌্যাব-৭ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ ইউসুফ।

এই ঘটনার ‘হোতা’ হিসেবে গ্রেপ্তার মোহাম্মদ আজিমকে ছাত্রলীগের সমর্থক হিসেবে স্বীকার করলেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক রুবেল বলেছেন, এই অপকর্মের দায় সংগঠন নেবে না।

গত ১৭ জুলাই রাতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের হতাশার মোড় থেকে হলে ফেরার পথে এক ছাত্রী ও তাঁর বন্ধুকে আটকে বোটানিক্যাল গার্ডেন এলাকায় নিয়ে যৌন নিপীড়ন করে কয়েকজন। ওই ছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টাও করা হয় বলে অভিযোগ।

পরে ওই শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিযোগ করলে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ২০ জুলাই ওই শিক্ষার্থী হাটহাজারী থানায় মামলা করেন।

এই ঘটনায় শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ-বিক্ষোভের মধ্যে ৪ জনকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়ে শনিবার (২৩ জুলাই) র‌্যাব-৭ এর চান্দগাঁও ক্যাম্পে সংবাদ সম্মেলনে আসেন বাহিনীর কর্মকর্তারা।

গ্রেপ্তার তাঁদের মধ্যে দুজন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র। তবে অভিভাবকের চাকরি সূত্রে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় থাকেন। অন্য দু’জন হাটহাজারী কলেজের ছাত্র।

গ্রেপ্তার বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র দু’জনের মধ্যে মোহাম্মদ আজিমকে (২৩) ঘটনার হোতা বলছে র‌্যাব। ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এই ছাত্রের বাড়ি নোয়াখালীর হাতিয়ার চরে। তাঁর বাবার নাম আমির হোসেন। এখন হাটহাজারীর ফতেহপুরে থাকেন তাঁরা।

গ্রেপ্তার নুরুল আবছার বাবু (২২) বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তাঁর বাবা বেলায়েত হোসেন ফেনীর পরশুরামের বেড়াবাড়ির বাসিন্দা। এখন থাকেন হাটহাজারীর ফতেহপুরে।

গ্রেপ্তার অন্য দু’জনের মধ্যে নূর হোসেন শাওন (২২) হাটহাজারীর ফতেহপুরের জাবেদ হোসেনের ছেলে। তিনি হাটহাজারী কলেজের সমাজ বিজ্ঞানের প্রথম বর্ষের ছাত্র।

গ্রেপ্তার মাসুদ রানা (২২) হাটহাজারী কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তিনি ঝালকাঠির আশিয়ার গ্রামের আব্দুল মান্নানের ছেলে।

গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের রাজনৈতিক পরিচয় সাংবাদিকেরা জানতে চাইলে র‌্যাব-৭ এর অধিনায়ক ইউসুফ বলেন, তাঁরা নিজেরা ছাত্রলীগে যুক্ত বলে দাবি করেছেন। তবে তাঁদের কোনও পদ-পদবি নেই।

তিনি বলেন, আজিম নিজেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতির অনুসারী ও অন্যরা অপর পক্ষের বলে দাবি করেছেন। যেহেতু তাঁদের কোনও পদ-পদবি নেই, তাঁদের আমরা কোনও দলের কর্মী বলতে পারি না।

চবি ছাত্রলীগ সভাপতি রুবেলকে কেন্দ্রের নোটিশ : ঘটনার পরদিন ১৮ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে ওই ছাত্রী লিখিত অভিযোগ দিতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল হক রুবেল বাধা দিয়েছিলেন বলে ওই ছাত্রীর এক বন্ধু অভিযোগ করেছিলেন।

তা নিয়ে রুবেল সমালোচনায় পড়েন। এর মধ্যে তাঁকে কারণ দর্শাও (শোকজ) নোটিশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।

আজিম তাঁর অনুসারী কি-না, প্রশ্ন করা হলে রুবেল বাঙলা কাগজ ও ডনকে বলেন, ‘আজিম আমার অনুসারী না। সে সিএফসি গ্রুপের অনুসারী।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রেনের বগিভিত্তিক দলের একটি ‘সিএফসি’, ছাত্রলীগের কমিটি না থাকার সময় থেকে এই সংগঠনের নেতারাই এই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

রুবেল নিজেও এক সময় ‘সিএফসি’র নেতৃত্বে ছিলেন। এখন তিনি বলছেন, ‘এক সময় আমি যুক্ত থাকলেও বর্তমানে আমি চবি ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দিচ্ছি। কোনও গ্রুপের অপকর্মের দায় আমি নেবো না। আজিম যদি অপরাধ করে, তাহলে তাঁর বিচার হবে। এক্ষেত্রে সংগঠন কারও দায়ভার নেবে না।’

ফেসবুকে আজিমের সঙ্গে রুবেলের ছবি এই ঘটনার পর সামনে এসেছে। তা নিয়ে প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ছাত্রলীগের সভাপতি হওয়ার পর অনেকে আমার সঙ্গে ছবি তু্লতে আসে, আমি না করতে পারি না।’

রুবেল দাবি করেন, তিনি আজিমকে ধরিয়ে দিতে তথ্য দিয়ে র‌্যাবকে সহায়তা করেছেন।

ওই ছাত্রীকে অভিযোগ দিতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ এর আগেই অস্বীকার করেন রুবেল।

২০১৯ সালের ১৪ জুলাই রেজাউল হক রুবেলকে সভাপতি ও ইকবাল হোসেন টিপুকে সাধারণ সম্পাদক করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা হয়েছিলো। ১ বছরের জন্য গঠিত এই কমিটি ৩ বছরেও পূর্ণাঙ্গ হয় নি।

রুবেল চট্টগ্রামের স্থানীয় রাজনীতিতে প্রয়াত এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর ধারার অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

র‌্যাবের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, শুক্রবার রাতে চট্টগ্রামের রাউজান ও হাটহাজারী উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়।

আজিমকে ‘মূল অভিযুক্ত’ উল্লেখ করে র‌্যাব-৭ এর অধিনায়ক বলেন, ‘ঘটনার পর সে রাউজানে তাঁর ফুপুর বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলো।’

আজিমকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এই ঘটনায় মোট ৬ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি। তাঁদের মধ্যে ৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হলেও সাইফুল নামের ২ জনকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

গ্রেপ্তারদের কাছ থেকে ২টি মোটর সাইকেল এবং ৩টি মোবাইল ফোন উদ্ধারের কথা জানিয়েছে র‌্যাব।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইউসুফ বলেন, ঘটনাটি পূর্ব পরিকল্পিত ছিলো না। গ্রেপ্তার হওয়ারা রাতের বেলায় ক্যাম্পাসে আড্ডা দিতেন। দুটি মোটর সাইকেলে করে তাঁরা ওই পথে যাচ্ছিলেন। সে সময় ভিকটিম ছাত্রীকে তাঁর এক বন্ধুসহ ওই এলাকায় দেখতে পেয়ে জেরা করতে থাকেন। এ সময় ওই ছাত্রী তাঁদের বাধা দেওয়ায়, তাঁরা মারধর শুরু করে এবং তাঁর বন্ধুকে বেঁধে রাখে। ওই ছাত্রীকে শ্লীলতাহানি করে আজিম নিজের, ওই ছাত্রীর এবং ছাত্রীর বন্ধুর মোবাইলসহ মোট ৩টি মোবাইলে অশ্লীল ভিডিও ধারণ করে। এ সময় তাদের একজন ওই ছাত্রীকে শারীরিক সম্পর্ক করতে চাপ দেয় এবং ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়।’

প্রায় ঘণ্টাখানেক আটকে রেখে তাঁরা ওই ছাত্রী এবং তাঁর বন্ধুর কাছ থেকে নগদ ১৩ হাজার ৭ শ টাকা ও মোবাইল ফোন নিয়ে যায় বলে জানান র‌্যাবের এই কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, ‘ঘটনার পরপর ভিকটিম ট্রমার মধ্যে ছিলেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে আশেপাশের বিভিন্ন ঘটনা পর্যালোচনা করে ৬ জনকে শনাক্ত করা হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রথম থেকে আমরা মাথায় রেখেছি নিরীহ কেউ যেনো এ ঘটনায় জড়িয়ে না পড়েন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাদের বিভিন্ন বিষয়ে সহায়তা করেছে। পাশাপাশি রাজনৈতিক সংগঠনগুলো বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছেন আসামি শনাক্তে।’