চট্টগ্রামে কয়েকটি ব্যাংকের ঋণ ফেরত আসা নিয়ে শঙ্কা।

চট্টগ্রামে কয়েকটি ব্যাংকের ঋণ ফেরত আসা নিয়ে শঙ্কা।
বাঙলা কাগজ ডেস্ক : ভোগ্যপণ্যের দামের ওঠানামা ও জাহাজ নির্মাণশিল্পে মন্দার কারণে একসময় চট্টগ্রামের ব্যবসায়ে বড় ধাক্কা লাগে। এর ফলে ২০১০ সালের পর চট্টগ্রামের অনেক ব্যবসায়ীই ঋণখেলাপি হয়ে পড়েন। তাঁদের অনেকেই এক ব্যবসায়ের নামে ঋণ নিয়ে তা অন্য খাতে ব্যবহার করেছিলেন। কেউ কেউ আবার দেশ ছেড়ে পালান কিংবা বিদেশে অবৈধ সম্পদ গড়ে তোলেন। এ রকম পরিস্থিতিতেও চট্টগ্রাম অঞ্চলে ব্যাংকগুলোর ঋণ বিতরণের গতি একটুও কমে নি। বরং রাজধানী ঢাকার মতো সেখানেও তারা সমানতালে ঋণ দিয়ে যাচ্ছে। আলাপকালে কয়েকজন ব্যাংকার বলেন, বড় ধাক্কা খাওয়ার পর চট্টগ্রামে ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলো সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। এ অঞ্চলে ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে তাঁদের তেমন আগ্রহ নেই। তবে বেশ কিছু ব্যাংকের মালিকানা চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীর হাতে, এ কারণে কিছু ব্যাংক এখনো সেখানে দেদার ঋণ দিয়ে চলেছে। আবার ইস্পাত ও ভোগ্যপণ্য খাতের কিছু ভালো ব্যবসায়ীকেও অনেক ব্যাংক বড় অঙ্কের অর্থায়ন করে যাচ্ছে। এ দুটি কারণে চট্টগ্রাম অঞ্চলে ঋণ বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২১ সালের ডিসেম্বরে চট্টগ্রাম বিভাগে ব্যাংকগুলোর ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ২ লাখ ২৪ হাজার ৮৪ কোটি টাকা, যা ছয় বছর আগে ২০১৫ সালে ছিলো ১ লাখ ১০ হাজার ৭২৬ কোটি টাকা। ফলে ৭ বছরের ব্যবধানে চট্টগ্রাম অঞ্চলে ঋণ বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এই সময়ে এত ঋণ বৃদ্ধি পাওয়াকে ‘অস্বাভাবিক’ বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা। জানতে চাইলে বেসরকারি খাতের মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘একসময় ব্যাংকগুলোর মূল ব্যবসা ছিলো চট্টগ্রামে। বড় ধাক্কা খাওয়ার পর সবাই শিক্ষা নিয়েছে। ভালো করপোরেট প্রতিষ্ঠান ছাড়া ব্যাংকগুলো এখন চট্টগ্রামের কাউকে ঋণ দিচ্ছে না। এরপরও এতো ঋণ বৃদ্ধি পাওয়াটা অস্বাভাবিক।’ পাঁচ-সাতটি ব্যাংকের কারণে ওই অঞ্চলে ঋণ এতো বাড়তে পারে বলে মনে করেন তিনি। এদিকে চট্টগ্রামে সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতের ঋণ বেড়ে দ্বিগুণ হলেও কিছু ব্যাংকের ক্ষেত্রে তা তিন গুণ হয়ে গেছে। চট্টগ্রামে সমস্যা দেখে অধিকাংশ ব্যাংক যখন হাত গুটিয়ে নিয়েছে, তখন অল্প কয়েকটি যেনো আগের চেয়েও উদার হস্তে ঋণ দিয়ে যাচ্ছে। যেমন চট্টগ্রাম অঞ্চলে বেসরকারি ইসলামী ব্যাংকের দেওয়া ঋণের পরিমাণ ২০১৬ সালে ছিলো ১২ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা। তা গত বছরের শেষে বেড়ে হয়েছে ৩৭ হাজার ৮৯১ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০১৬ সাল পরবর্তী পাঁচ বছরে চট্টগ্রাম বিভাগে ব্যাংকটির ঋণ বিতরণ বেড়েছে ২৫ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা। একইভাবে ২০১৬ সালে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের (এসআইবিএল) ঋণের পরিমাণ ছিলো ২ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা, যা ২০২০ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৬ হাজার ২৩১ কোটি টাকায়। একই সময়ে এই ব্যাংকের ঋণ বিতরণ প্রায় আড়াই গুণ বেড়েছে। এই দুটি ব্যাংকের একটি বড় অংশের শেয়ার এখন চট্টগ্রামভিত্তিক এক শিল্পগ্রুপের হাতে রয়েছে। তবে বেসরকারি খাতের ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের (ইবিএল) নিয়ন্ত্রণ চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীর হাতে থাকলেও এই ব্যাংকটি ওই অঞ্চলে সেভাবে ঋণ বাড়ায় নি। চট্টগ্রাম বিভাগে ইবিএলের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ২০১৬ সালে ছিলো ৪ হাজার ২২ কোটি টাকা, যা ২০২১ সাল শেষে হয়েছে ৫ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা। এ নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, ‘চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপ সাতটি ব্যাংকের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ইচ্ছেমতো ঋণ দিচ্ছে। কাকে ঋণ দিচ্ছে, কোথায় ঋণ ব্যবহৃত হচ্ছে, তার কোনও হিসাব নেই। এ জন্য এই অঞ্চলে ঋণ বাড়ছে। এসব বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর কোনও আগ্রহ নেই। বরং তিনি ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ও প্রকৃত চিত্র লুকিয়ে রাখতে তৎপর। এর ফলে পরিস্থিতি দিনে দিনে ভয়াবহ হয়ে উঠছে।’ জানা গেছে, ব্যাংক খাতের সর্বোচ্চ ৬৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ ঋণ বিতরণ হয়েছে ঢাকায়। এরপর চট্টগ্রামে ১৮ দশমিক ৫১ শতাংশ, খুলনায় ৩ দশমিক ৯১ শতাংশ, রাজশাহীতে ৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ, রংপুরে ২ দশমিক ৪২ শতাংশ, ময়মনসিংহে ১ দশমিক ৩৬ শতাংশ, সিলেটে ১ দশমিক ২৪ শতাংশ ও বরিশালে ১ দশমিক ১৫ শতাংশ ঋণ বিতরণ হয়েছে। ব্যাংক খাতের দেওয়া ঋণের পরিমাণ গত ডিসেম্বরে দাঁড়িয়েছিলো ১২ লাখ ১০ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকায়। চট্টগ্রামের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে যমুনা ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক কাজী শামসুল হক বলেন, ‘পাঁচ বছর আগে খাতুনগঞ্জে ঋণ নেওয়ার মতো ৫ শ গ্রাহক ছিলো। এর বেশির ভাগই ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন, কেউ কেউ আবার পালিয়ে গেছেন। এখন ভালো ব্যবসায়ী আছেন সর্বোচ্চ ৬০ থেকে ৭০ জন। এজন্য আগের চেয়ে সেভাবে ঋণ বাড়ার সুযোগ নেই। আমাদের ব্যাংকের ঋণ ২০১৫ সালের তুলনায় ২০ কোটি টাকা বেড়েছে। আমরা বুঝেশুনে শুধু ভালোদের অর্থায়ন করছি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঋণপত্র খোলা ও গ্যারান্টি দেওয়া হচ্ছে।’