কষ্টে চলছে বাঘার মুক্তিযোদ্ধা সামসুদ্দিনের শিশু সদন ও বৃদ্ধাশ্রম।
নিজস্ব প্রতিবেদক, বাঙলা কাগজ; লিয়াকত হোসেন, রাজশাহী : মানুষ মানুষের জন্য। এই ধ্রুব সত্য কথার সঙ্গে কাজের মিল রয়েছে বলেই মানুষ আজও একে অপরকে ভালবাসে, শ্রদ্ধা ও সম্মান করে এবং পাশে দাঁড়ায়। বিশেষ করে, এতিম সন্তানেরা অত্যন্ত অসহায়। তাঁদের বাবা ও মা এবং কোনও অভিভাবক না থাকায় অনেক অসহায় তাঁরা। পাশাপাশি বৃদ্ধ-বৃদ্ধারাও কিছুক্ষেত্রে অসহায়।
জানা গেছে, অনেক পরিবারে বাবা মারা গেলে, মা অসহায় হয়ে পড়েন, নিজ সন্তানকে লেখাপড়া ও ভরণ-পোষণের জন্য। ফলে তাঁরা তাঁদের সন্তানদেরকে এতিমখানায় দিয়ে দেন। আবারও অনেক সন্তান ভবঘুরে হয়ে রাস্তায় নামেন। এই ধরনের সন্তানদের পাশে দাঁড়িয়েছেন রাজশাহীর বাঘা উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা সামসুদ্দিন সরকার ও তাঁর স্ত্রী মেহেরুন্নেসা।
তাঁরা বাঘা উপজেলার গড়গড়ি ইউনিয়নের পদ্মা নদীর তীর ঘেঁষা সরেরহাট গ্রামে ১৯৮৪ সালের পহেলা জানুয়ারি ১২ শতাংশ জমি কিনে একটি এতিমখানা গড়ে তোলেন। এখানে মেহেরুন্নেসা তাঁর মোহরানার টাকা দিয়ে দেন। এতিম-অনাথ ও ছিন্নমূল শিশু এবং বৃদ্ধ ও বৃদ্ধাদের মুখে ৩ বেলা খাবার তুলে দেওয়া, আর শিক্ষা নিশ্চিত করতে তাঁরা প্রায় ৪ দশক ধরে ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করে চলেছেন। আর এই ধরনের সেবা করতে গিয়ে নিজেদের ১৮ বিঘা জমি বিক্রি করে, এখন বীর মুক্তিযোদ্ধা সামসুদ্দিন সরকার প্রায় নিঃস্ব।
তবুও তাঁরা এই এতিমখানা ও বৃদ্ধাশ্রম নিয়েই পড়ে রয়েছেন।
বর্তমানে সরেরহাট কল্যাণী শিশু সদনে ১৫১ জন এতিমকে নিয়ে সামসুদ্দিন তাঁর স্ত্রী পরিবারসহ সবাই একসঙ্গে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। এলাকার ৪৮ জন বৃদ্ধা ও বৃদ্ধও রয়েছেন তাঁদের বৃদ্ধাশ্রমে।
শত সন্তানের বাবা সামসুদ্দিন সরকার বাঙলা কাগজ ও ডনকে জানান, ১৯৮৪ সালে যাত্রা শুরুর ১০ বছর পর ‘সরেরহাট কল্যাণী শিশু সদন' নামে প্রতিষ্ঠিত এতিমখানার রেজিস্ট্রেশন পাওয়া যায়।
তিনি জানান, ২০০৭ সালে সাদামনের মানুষ হিসেবে পুরস্কার দেওয়া হয় তাঁকে। এরপর থেকে সামান্য কিছু আর্থিক অনুদান আসতে থাকে। কিন্তু তা এখনও পর্যাপ্ত নয়। ২৪টি ঘরে এখন ১৫১ জন শিশু এবং ৪৮ জন বৃদ্ধ গাদাগাদি করে বসবাস করছেন। তাঁদের জন্য রয়েছে মাত্র ৭টি বাথরুম।
আর ৩ বেলা ভালো খাবার জোটানো খুবই কঠিন হয়ে পড়ছে।
অধিকাংশ সময়ই ডাল-সবজি-ভাত খেতে হয়।
মাছ-মাংস জোটানো যেনো আকাশের চাঁদ হয়ে পড়েছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা সামসুদ্দিন সরকারের স্ত্রী মোসা. মেহেরুন্নেসা বাঙলা কাগজ ও ডনকে জানান, ২০১৩ সালে ইউনিলিভারের আয়োজনে ‘জয়িতা বেগম রোকেয়া পদক’ পেয়েছেন তিনি। এই মানুষজনের (শিশু সদন ও বৃদ্ধাশ্রম) সঙ্গে থাকতে থাকতে কোথাও গিয়ে এখন তাঁর থাকতে খুব কষ্ট হয়। তাঁদের অবস্থা খারাপ হলেও এই শিশুদের ছেড়ে কোথাও গিয়ে ভালো লাগে না।
তিনি আরও জানান, বেহেশতে গিয়ে থাকতে বললেও তিনি এই সন্তানদের ছেড়ে যাবেন না।
মেহেরুন্নেসা বলেন, শিশুরা বড় হচ্ছে। কিন্তু তাঁরা কোনও কাজ শিখতে পারছে না। যদি এতিমখানার পাশে একটি কারখানা হতো কিংবা শিশুদের হাতে-কলমে কারিগরি কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতো, তবে শিশুরা এখান থেকে বের হয়েই কাজে যোগ দিতে পারতো। তাঁদের বেকার থাকতে হতো না। এই শিশুদের কর্মমুখী করতে কারিগরী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানান তিনি।
সামসুদ্দিন সরকার বলেন, ঢাকার বারিধারার বাসিন্দা ফখরুল কবীর রিপনের সহায়তায় তিনি একটি বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তুলেছেন। রিপন প্রথম অবস্থায় শিশুদের জন্য ৫০ হাজার এবং বৃদ্ধাশ্রমের জন্য ৫০ হাজার টাকা করে দিতে থাকেন। সেইসঙ্গে বৃদ্ধাশ্রমে পুরুষদের জন্য ৩টি এবং নারীদের জন্য ৩টি ঘরও করে দেন। ওই টাকাতেই চলছে বৃদ্ধাশ্রম।
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা আরও জানান, এখন প্রতিমাসে খরচ হয় প্রায় ৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে রিপন দেন ১ লাখ টাকা, সরকারিভাবে ৪৩ হাজার টাকা এবং বাইরের বিভিন্ন জন ২০ হাজার টাকার মতো অনুদান দিয়ে থাকেন।
‘এ ছাড়া এই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম অনেক সহযোগিতা করেন। তারপরও এই টাকায় দুইটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা অত্যন্ত কষ্টকর হয়ে পড়েছে। সর্বদা আর্থিক সঙ্কট লেগেই থাকে।’
তিনি জানান, সারা বছরই তাঁদের দোকানে বাকি খেতে হয়। শিশু এবং বৃদ্ধ ও বৃদ্ধাদের যতোটুকু খাবার, জামা-কাপড় এবং শিক্ষা সামগ্রী দেওয়ার প্রয়োজন, তা তাঁরা দিতে পারছেন না। এরপরও তাঁরা থেমে থাকার মানুষ নন। কারণ তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। পরাজয় মানতে শেখেন নি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে জয়ী হতে চান আগামী দিনের সব সঙ্কটে। এই প্রতিষ্ঠান দুটি পরিচালনায় সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।
সহযোগিতার জন্য সরাসরি গিয়ে অথবা ডাক্তার সামশ, নম্বর : ০১৭১৮৫৪২৪৫৪ অথবা বাঙলা কাগজ ও আওয়ার ডনের রাজশাহী প্রতিনিধি লিয়াকত হোসেন, নম্বর : ০১৭১২১৮৫০৫১ তেও যোগাযোগ করা যাবে।