কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নগদ জমা রাখতে পারছে না এস আলমের শেয়ার থাকা ৫ ব্যাংক

কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নগদ জমা রাখতে পারছে না এস আলমের শেয়ার থাকা ৫ ব্যাংক

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ ও ডন : আমানতকারীদের অর্থের নিরাপত্তার প্রয়োজনে তলবি ও মেয়াদি দায়ের বিপরীতে চাহিদা অনুযায়ী প্রতিদিন বাংলাদেশ ব্যাংকে নগদ জমা (সিআরআর) সংরক্ষণ করতে পারছে না এস আলম গ্রুপের শেয়ার থাকা ৫ ইসলামী ব্যাংক। কারণ এসব ব্যাংক বর্তমানে তারল্য ঘাটতিতে রয়েছে। আর নগদ জমা সংরক্ষণ করতে না পারায় তাঁদের জরিমানা গুনতে হচ্ছে। তবে গ্রাহকদের টাকা জমা ও উত্তোলনে কোনও সমস্যা হচ্ছে না।

সিআরআর ও এসএলআর (বিধিবদ্ধ জমা) মুদ্রানীতিরও অন্যতম হাতিয়ার। এর মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেরও কাজ করে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

নিয়ম অনুযায়ী, ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোকে আমানতের সাড়ে ৫ শতাংশ এসএলআর ও ৪ শতাংশ সিআরআর হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকে রাখতে হয়। আর অন্যান্য ব্যাংকগুলোর জন্য যা দুটি মিলে ১৭ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকে নগদ জমা রাখতে না পারা এস আলমের শেয়ার থাকা ওই পাঁচ ব্যাংক হলো- ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (এসআইবিএল), ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি মাসের মাঝামাঝি থেকে এই ৫ ব্যাংকের ১০ কোটি টাকার বেশি ঋণ বিতরণ ও আদায়ের তথ্য সংগ্রহ করা শুরু করেছে, পাশাপাশি ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে পর্যবেক্ষক বসিয়েছে।

জানা গেছে, গত ৩১ অক্টোবর ইসলামী ব্যাংকের আমানত ছিলো ১ লাখ ৫৩ হাজার ২৭২ কোটি টাকা; যা গত বৃহস্পতিবার (২২ ডিসেম্বর) কমে হয় ১ লাখ ৪০ হাজার ২২১ কোটি টাকা। একইভাবে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের আমানত কমেছে প্রায় ১ হাজার ১ শ কোটি টাকা, এসআইবিএলের কমেছে প্রায় ২ শ কোটি টাকা। ফার্স্ট সিকিউরিটি ও ইউনিয়ন ব্যাংকের অবস্থা আরও খারাপ।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বাঙলার কাগজ ও ডনকে বলেন, সিআরআর ঘাটতির জন্য নিয়মানুযায়ী জরিমানা গুনতে হবে। তারল্য পরিস্থিতির উন্নতি করার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হবে।

এখন ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোকে দৈনিক ভিত্তিতে আমানতের ন্যূনতম সাড়ে ৩ শতাংশ ও দ্বিসাপ্তাহিক ভিত্তিতে ৪ শতাংশ অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখতে হয়। চাহিদা অনুযায়ী জমা রাখতে ব্যর্থ হলে জরিমানা গুনতে হয়।

গত সপ্তাহের বেশিরভাগ দিনই এই পাঁচ ব্যাংক চাহিদা অনুযায়ী সিআরআর রাখতে পারে নি। বৃহস্পতিবার ইসলামী ব্যাংকের ৫ হাজার ৫০ কোটি টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ১ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা, ইউনিয়ন ব্যাংকের ৫৪১ কোটি টাকা, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৩০৫ কোটি টাকা এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৮২ কোটি টাকা সিআরআর ঘাটতি ছিলো।

কেনো এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা জানতে যোগাযোগ করা হলে চার ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকেরা কোনও সাড়া দেন নি।

তবে সবচেয়ে কম ঘাটতিতে পড়া গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ হাবিব হাসনাত বলেন, ‘বছরের শেষ মাসে অনেক আমানতের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এর মধ্যে কেউ উত্তোলন করেন, আবার কেউ নতুন করে রাখেন। এদিকে মেয়াদ পূর্ণ হওয়ায় ইসলামী ব্যাংককে তাঁদের আমানত ফেরত দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে নতুন করে অন্য ব্যাংক থেকে তহবিল পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাহিদানুযায়ী প্রতিদিন টাকা জমা রাখা যায় নি। সময় একটু খারাপ যাচ্ছে, আশা করছি, পরিস্থিতি ভালো হয়ে যাবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, অনেকগুলো ব্যাংক একটি গ্রুপ তথা এস আলম গ্রুপের হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়ায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ফলে একটির প্রভাব পড়ছে অন্যটিতে। এভাবেই পদ্ধতিগত ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

এদিকে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক। এটি দেশে ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোর অন্যতম অর্থ জোগানদাতাও। তাই এটি তারল্যসঙ্কটে পড়ায় অন্য ইসলামি ব্যাংকগুলোয় প্রভাব পড়েছে। এসব ব্যাংককে প্রায় আট হাজার কোটি টাকা জমা ও ধার দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক, যা ফেরত পাচ্ছে না। এতে দেশের বৃহত্তম ব্যাংকটির সঙ্কট প্রকট হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, এসব ব্যাংক নামে-বেনামে আগ্রাসী বিনিয়োগ করেছে, যা আদায় হচ্ছে না। এর ওপর অনেক আমানতকারী জমানো টাকা তুলে নিয়েছেন। এতে সঙ্কট বেড়েছে।

সূত্র জানায়, ২০১৭ সালে শেয়ার ধারণ করে ইসলামী ব্যাংক ও এসআইবিএল থেকে নামে-বেনামে অনেক টাকা বের করে নিয়েছে এস আলম গ্রুপ। আর অন্য তিনটি ব্যাংকের শেয়ারেও রয়েছে এস আলম গ্রুপ। এর মধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম (মাসুদ)। 

শেয়ার পরিবর্তনের আগে ইসলামী ব্যাংকের বড় শাখা ছিলো মতিঝিলের স্থানীয় শাখা। এখন সবচেয়ে বড় শাখা চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ। এটির ঋণ প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা, যা ২০১৭ সালে ছিলো মাত্র ২ হাজার কোটি টাকা। নামে-বেনামে ঋণ নিতে ব্যাংকটির চট্টগ্রামের একাধিক শাখা, রাজধানীর বারিধারা, গুলশান-১ ও ২ শাখা, ফার্মগেট, ভিআইপি রোড, নবাবগঞ্জ ও পাবনা শাখাকেও বেছে নেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের দেওয়া হয়েছে একাধিক ‘বিশেষ পদোন্নতি’।