এক কিশোর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধার কথা

এক কিশোর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধার কথা

চন্দনা সান্যাল : বীর মুক্তিযোদ্ধা দেবেশ চন্দ্র সান্যাল একজন কিশোর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা। তিনি আমার পিতা। তাঁর বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার হাবিবুল্লাহ নগর ইউনিয়নাধীন রতনকান্দি গ্রামে। তিনি ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন কিশোর বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি জাতির ক্রান্তিকালে জীবনপণ মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি তখন ছিলেন রতনকান্দি আদর্শ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। তিনি তদানীন্তন শাহজাদপুরের এমপিএ অ্যাডভোকেট জনাব আব্দুর রহমান ও অন্যান্য ২২ জনের সঙ্গে একযোগে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারত গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। তিনি ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে একটি গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপের একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দেশের অভ্যন্তরে এসেছিলেন। তিনি দেশের অভ্যন্তরে এসে পাকিস্তানি সৈন্য ও তাঁদের এ দেশীয় দোসর রাজাকারদের বিরুদ্ধে ৩ টি ‘হিট অ্যান্ড রান’ কর্মসূচি ও ৪ টি ভয়াবহ সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন জনাব এম এ মান্নান। ৭ নম্বর সেক্টরের হেড কোয়ার্টার ভারতের তরঙ্গপুর থেকে একটি গেরিলা গ্রুপ করে দিয়েছিলেন। প্রথমত তাঁর গ্রুপের ভারতীয় প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সদস্য সংখ্যা ছিলো ১০ জন। তিনিসহ যোদ্ধারা হলেন ১. রবীন্দ্র নাথ বাগচী, ২. নজরুল ইসলাম, ৩. রতন কুমার দাস এবং অন্যান্য ৬ জন। তাঁর গ্রুপ যুদ্ধের পাশাপাশি রাজাকারদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেশের স্বাধীনতার পক্ষে আসার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তাঁদের গ্রুপ যে চারটি ভয়াবহ সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বিজয়ী হয়েছে, তা নিচে দেওয়া হলো। যুদ্ধ সম্পর্কে বলেছেন আমার পিতা :

১) বেলকুচি থানা আক্রমণ যুদ্ধ : বেলকুচি সিরাজগঞ্জ জেলার একটি উল্লেখযোগ্য থানা। অক্টোবর, ১৯৭১ সালের শেষের দিকে আমরা এই থানা আক্রমণ করেছিলাম। এই থানা আক্রমণ যুদ্ধে নেতৃত্বে ছিলেন আমাদের গ্রুপ কমান্ডার জনাব এম এ মান্নান স্যার। কমান্ডার স্যার এবং আরও ৩ জনের রেকিতে একযোগে বেলকুচি থানা ও মুসলিম লীগ নেতা আব্দুল মতিনের বাড়ি আক্রমণ করলাম। সন্ধ্যায় বানিয়া গাতি গ্রামের এক বাড়ির শেল্টারে কমান্ডার স্যার বিস্তারিত ব্রিফ করলেন। আমাদের দুই গ্রুপে ভাগ করে দিলেন। সিদ্ধান্ত হলো : কমান্ডার স্যারের নেতৃত্বে বড় গ্রুপটি থানা আক্রমণ করবে, অন্য গ্রুপটি রবীন্দ্র নাথ বাগ্‌চীর নেতৃত্বে মতিন সাহেবের বাড়ি আক্রমণ করে মতিন সাহেবকে ধরে আনবে। আমি কমান্ডার স্যারের গ্রুপে থেকে থানা আক্রমণ যুদ্ধে অংশ নিলাম। রাত ৯টায় বানিয়া গাতি থেকে যাত্রা করলাম। থানার কাছে গিয়ে দু গ্রুপ টার্গেটের উদ্দেশ্যে ভাগ হয়ে গেলাম। নিদিষ্ট সময়ে রাত ১২টায় একযোগে আক্রমণের সিদ্ধান্ত হলো। পরিকল্পনা মোতাবেক থানার পশ্চিম পাশ দিয়ে স্ক্রোলিং করে থানার সামনে যেতেই সেন্ট্রি দেখে ফেললো। হুইসেল বাঁজিয়ে থানার সবাইকে জানিয়ে দিয়ে আমাদেরকে লক্ষ্য করে গুলি চালালো। আমাদের কমান্ডার স্যার কমান্ড করে ফায়ার ওপেন করলেন। আমরা সবাই একযোগে গুলি করলাম। একঘণ্টা ব্যাপী যুদ্ধ চললো। ভয়াবহ যুদ্ধ। আমার মাথায় হেলমেট। দুইটি গুলি এসে হেলমেটে লাগলো। আমার ডান পাশে আমার কমান্ডার। হয় বিজয় আর না হয় মৃত্যু ছাড়া কোনও পথ নাই। বৃষ্টির মতো গুলি চালিয়ে যাচ্ছি। যুদ্ধের এক সময়ে কমান্ডার স্যার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘দেবেশ মাথা তুলো না, গুলি চালিয়ে যাও।’ 

আমাদের বৃষ্টির মতো গুলিতে থানার বিহারী পুলিশ ও রাজাকার থানার পিছন দিক দিয়ে পালিয়ে সোহাগপুর নদীতে থাকা একটি লঞ্চে চড়ে আমাদের রেঞ্জের বাইরে যমুনার মধ্যে চলে গেলো। থানার সেন্ট্রি গুলি করা বন্ধ করে দুই হাত উপরে তুলে আত্মসমর্পণ করলো।

আমরা থানার ভিতরে ঢুকে পড়লাম। আমরা থানার মালখানা থেকে সকল গোলাবারুদ নিলাম। থানার দু’জন রাজাকারকে জ্যান্ত বেঁধে ধরে নিয়ে এলাম। রাজাকাররা যাতে আমাদের শেল্টার চিনতে না পারে, সেজন্য তাদের চোখ বেঁধে নিয়ে এলাম। ভোর হয়ে গেলো। মতিন সাহেবের বাড়ি আক্রমণ করা দলটিও এলো। মতিন সাহেব পালিয়ে গেছে। তাকে ধরা সম্ভব হয় নাই। থানার আশেপাশের লোকজন দোকান ও বাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দিলো। বিজয়ী হয়ে চলে এলাম। 

পরদিন সিরাজগঞ্জ থেকে শতাধিক পাকি হানাদার ও রাজাকার এসে থানার আশেপাশে আগুন দিয়েছিলো এবং মানুষদের নির্যাতন করেছিলো। বেলকুচি থানা আক্রমণ যুদ্ধে আমরা ২ জন রাজাকারকে ধরে এনেছিলাম। কিছু সময় চোখ বেঁধে আমাদের শেল্টারের ও আলাদা রুমে রেখেছিলাম। তাদেরকে চোখ বেঁধে পাশের রুমে রাখা হয়েছিলো। আমি কমান্ডার স্যারের অনুমতি নিয়ে ওদের সঙ্গে কথাবার্তা বললাম। তাদেরকে রাজাকার হওয়ার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম ও শুনলাম। ওদের জিজ্ঞাসাবাদে মনে হলো, ওরা সহজ সরল ও অভাবী মানুষ। ওদের বাড়িতে স্ত্রী ও পুত্র-কন্যা আছে। পিস কমিটির লোকদের কথায় বিশ্বাস করে ওরা রাজাকার হয়েছে। ওরা মনে করেছিলো, এটা একটা চাকুরি। উপার্জন করে সংসার পরিচালনার জন্য ওরা রাজাকার হয়েছে। তারা বললো, আমরা কাউকে কোনও অত্যাচার করি নাই। কোনও বাড়িঘর লুটতরাজ করি নাই। পাকিস্তানি হানাদারদের নিয়ে এসে কোনও গণহত্যা করি নাই। কোনও বাড়িতে আগুন দিই নাই...। তাদের কথায় আমার মায়া হলো। আমি তাদের চোখ বাঁধা খুলে দিলাম। তাদেরকে বিভিন্নভাবে বোঝালাম। রাতে শেল্টার পরিবর্তনের সময় কমান্ডার স্যারকে অনুরোধ করে রাজাকার দুইজনকে ছেড়ে দিয়েছিলাম।

২) কালিয়া হরিপুর রেলওয়ে স্টেশনে পাকিস্তানি সৈন্য ও ব্রিজ পাহারারত রাজাকারদের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধ করার জন্য অ্যাম্বুস : কালিয়া হরিপুর সিরাজগঞ্জ জেলার কামারখন্দ থানার একটি রেলওয়ে স্টেশন। এই অ্যাম্বুসের নেতৃত্বে ছিলেন গ্রুপ কমান্ডার জনাব এম এ মান্নান স্যার। ৪ নভেম্বর, ১৯৭১ সালে আমাদের গ্রুপের ঝাঐল গ্রামের সিরাজগঞ্জের এমএনএ জনাব মোতাহার হোসেন তালুকদারের ভায়রা আওয়ামী লীগ নেতা জনাব আব্দুল হামিদ তালুকদারের রেকির ভিত্তিতে কালিয়া হরিপুর রেলওয়ে স্টেশনে পাকিস্তানি সৈন্য ও ব্রিজ পাহারারত রাজাকারদের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধ করার জন্য অ্যাম্বুস করেছিলাম। কালিয়া হরিপুর যুদ্ধে যাওয়ার সময় আমার রণাঙ্গনের সাথী জনাব আব্দুল হামিদ তালুকদার সাহেব বললেন, ‘দেবেশ, মানিকাচর তোমার বাবা-মাসহ পরিবারের সবার সঙ্গে দেখা করেছি। সবাই ভালো আছেন। তোমার রেশন ও পকেট মানির টাকা তোমার আব্বার হাতে দিয়ে এসেছি। তোমার এক ভাই আমার সঙ্গে এসেছে, তাঁকে শমেসপুর গ্রামে এক বাড়িতে রেখে এসেছি। আগামীকাল সে তোমার কাছে আসবে।’ 

ওই অ্যাম্বুস যুদ্ধ হয় নাই। কমান্ডার স্যার স্ক্রোলিং করে রেললাইনে বৈদ্যুতিক মাইন বসিয়ে এসেছিলেন। তথ্য ছিলো ঈশ্বরদী থেকে পাকি হানাদার নিয়ে একটি ট্রেন সিরাজগঞ্জ যাবে। কমান্ডার স্যার ট্রেনটি উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করলেন। আমরা ধানক্ষেতের মধ্যে পজিশন অবস্থায় থাকলাম। কামান্ডার স্যারের হাতে মাইনের তার ও ব্যাটারি। টর্চলাইট ও হ্যারিকেন হাতে পাকি মিলিশিয়া ও রাজাকারেরা স্টেশনে টহল দিচ্ছিলো। ওদের পায়ে লেগে হঠাৎ আমাদের মাইনের তার বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। মাইনটি ওদের নজরে পড়লো। হুইসেল দিয়ে রাজাকারদের পজিশনে রেডি থাকতে বললো। আমাদের দিকে টর্চলাইট মেরে মেরে উর্দুতে বকাবকি করতে থাকলো। 

ইতিমধ্যে ঈশ্বরদী থেকে সিরাজগঞ্জগামী পাকি হানাদারবাহী ট্রেন এলো। পাকি হানাদারেরা সিগন্যাল দিলো। তারা স্টেশনে ট্রেনটি থামিয়ে দিলো। ট্রেনের পাকি হানাদারেরা অস্ত্র তাক করা অবস্থায় নেমে আমাদেরকে খুঁজতে থাকলো। মাইনের বৈদ্যুতিক তার বিছিন্ন হয়ে পরায় আমাদের মাইনটি ব্রাস্ট করা সম্ভব হলো না। পাকি হানাদারদের সংখ্যাধিক্যতায় ও অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় কমান্ডার স্যার উইথড্র হওয়ার কমান্ড করলেন। আমরা উইথড্র হয়ে কমান্ডার স্যারের বাড়ি বেলকুচি থানার তামাই গ্রামে এলাম। পরেরদিন সিরাজগঞ্জ থেকে পাকি হানাদার ও রাজাকারেরা এসে কালিয়া হরিপুর ও পাশের কয়েকটি গ্রামের কয়েকটি বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিলো। কিছু লোকের উপর নির্যাতন চালিয়েছিলো। আমরা কালিয়া হরিপুর রেলওয়ে স্টেশন অ্যাম্বুস থেকে ফিরে এসে তামাই গ্রামে কমান্ডার স্যারের বাড়িতে একত্রিত হই। কমান্ডার স্যারের মা আমাদের জন্য খাবার ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। আমরা কমান্ডার স্যারের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করলাম। খাওয়া-দাওয়ার পর আমাদের সবাইকে বসিয়ে কমান্ডার স্যার ব্রিফ করলেন। স্থানীয়ভাবে ট্রেনিং দেওয়া বেশকিছু যুবককে আমাদের গ্রুপে ভর্তি করা হলো। এতো বড় প্লাটুন এক শেল্টারে, শেল্টার নেওয়া সমস্যা হলো। তাই কমান্ডার স্যার ডেপুটি কমান্ডার রবীন্দ্র নাথ বাগ্‌চীকে কমান্ডার করে আমাদের ১১ জনের আর একটি গ্রুপ করে দিলেন।

৩) কল্যাণপুর যুদ্ধ : কল্যাণপুর সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি থানার একটি গ্রাম। ৫ নভেম্বর, ১৯৭১ এ কল্যাণপুর গ্রামে একটি যুদ্ধ হয়েছিলো। এই যুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলেন ডেপুটি কমান্ডার (কমান্ডার হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত) বাবু রবীন্দ্র নাথ বাগ্‌চী। কমান্ডার স্যারের নির্দেশে আমরা ১১ জন রবীন্দ্র নাথ বাগ্চীর কমান্ডনাধীন হয়ে হেঁটে ভোরে বেলকুচি উপজেলার কল্যাণপুর নামক গ্রামে এক বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। বাড়ির মালিক আমাদের সকালের খাবারের ব্যবস্থা করলেন। আমরা সারারাত নিদ্রাহীন থেকে ও হেঁটে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। সকালের খাবার খেয়ে প্রকাশ্যে পিটি-প্যারেড করলাম। অস্ত্র পরিষ্কার করলাম। অস্ত্রে ফুলথ্রু মারলাম। একজন করে করে আমাদের অবস্থান পাহারা দিতে থাকলাম। অন্যান্যরা কেউ কেউ ঘুম বা রেস্টে থাকলাম। কল্যাণপুর একটি নিভৃত গ্রাম। আমাদের ধারণা ছিলো, এই গ্রামে পাকি হানাদার ও রাজাকার আসবে না। বেলা ১০টার দিকে সেন্ট্রিরত সহযোদ্ধা রতনকুমার দাস দৌড়ে এসে জানালেন আমাদেরকে ধরার জন্য বেলকুচি থানা থেকে কয়েকজন পাকি হানাদার মিলিশিয়া ও রাজাকার আসছে। বওড়া গ্রামের মধ্য দিয়ে কল্যাণপুরের দিকে আসছে। দুইজন পাকিস্তানি দালাল গামছা দিয়ে মুখ বেঁধে নিয়ে হানাদার ও রাজাকারদের পথ চিনিয়ে নিয়ে আসছে। দূর থেকে অনুমান হলো এই দলে ৫জন মিলিশিয়া ও ৪ জন রাজাকার আছে। আমাদের কমান্ডার যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। আমরা কল্যাণপুরে রাস্তার ধারে বাঁশঝাড়ের মধ্যে পজিশন নিলাম। বাঁশঝাড়ের সামনে দিয়ে চলা রাস্তা ধরে পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকারেরা  আসছিলো। আমাদের রেঞ্জের মধ্যে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কমান্ডার রবীন্দ্রনাথ বাগ্চী কমান্ড ও ফায়ার ওপেন করলেন। আমরা একযোগে গুলি করা শুরু করলাম। এক লাফে হানাদারেরা রাস্তার উত্তরপাশে পজিশন নিলো। ওরাও আমাদের লক্ষ্য করে গুলি চালালো। আমরাও একযোগে বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়তে থাকলাম। গোলাগুলির শব্দ পেয়ে আশপাশে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ আমাদেরকে সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে এলো। এক ঘণ্টারও অধিক সময় সম্মুখ যুদ্ধ চললো। তারপর পাকি হানাদারেরা পিছিয়ে গেলো। যুদ্ধে জয়ী হয়ে আমরা বিজয় উল্লাস করলাম। সকল স্তরের মানুষের আত্মবিশ্বাস দৃঢ় হলো। এক বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করলাম। তারপর হেঁটে দৌলতপুর গ্রামের সহযোদ্ধা মুক্তি শামসুল হকের বাড়িতে শেল্টার নিলাম। ১৪ নভেম্বর, ১৯৭১ সালে এই শেল্টারে আমার মেজো দাদা সমরেন্দ্র নাথ সান্যাল আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। কয়েকদিন দৌলতপুর, তেঞাশিয়া, খুকনী, বাজিয়ারপাড়া, দরগার চর ও অন্যান্য গ্রামে থাকতে লাগলাম।

৪) ধীতপুর যুদ্ধ : ধীতপুর সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর থানার একটি গ্রাম। এই যুদ্ধে নেতৃত্বে ছিলেন ডেপুটি কমান্ডার (কমান্ডার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত) বাবু রবীন্দ্র নাথ বাগ্চী। ডিসেম্বর, ১৯৭১ এর প্রথম সপ্তাহের পর আমরা শেল্টার নিলাম সৈয়দপুর গ্রামের কালা চক্রবর্ত্তী ও অন্যান্যদের বাড়িতে। ১৩ ডিসেম্বর সংবাদ পেলাম পাকি হানাদারেরা কৈজুরী হয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। টাঙ্গাইলের যুদ্ধে পাকি হানাদারেরা পরাজিত হয়ে লঞ্চে যমুনা নদী পার হয়ে মালিপাড়া ক্যাম্পে এসেছে। মালিপাড়া ক্যাম্প থেকে রাস্তা চিনানোর জন্য দুইজন রাজাকারকে সঙ্গে নিয়েছে। আমরা পাকি হানাদারদের আক্রমণ করার জন্য ওদের পিছু নিলাম। সংবাদ পেয়ে শাহজাদপুুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপগুলোও আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে এলো। পাকি হানাদারেরা ছিলো ক্ষুধার্ত। কৈজুরী গ্রামের একজনের মূলা ক্ষেত থেকে মূলা খাওয়ার চেষ্টা করলো। ওরা হয়তো জানতো না কাঁচা মূলা খাওয়া যায় না। 

ওয়াপদা বাঁধ ধরে ওরা অগ্রসর হতে লাগলো। আমরাও নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে অস্ত্র তাক করে ওদের পিছু পিছু হাটতে থাকলাম। ওরা ভীষণ ক্রোধি। ধীতপুর নামক স্থানে গিয়ে ওরা আমাদের দিকে অস্ত্র তাক করলো। আমরা জাম্প করে ওয়াপদা বাঁধের পশ্চিমদিকে পজিশন নিলাম। ওদের উপর গুলি ছুড়তে শুরু করলাম। ওরা ওয়াপদা বাঁধের পূর্বপাশে পজিশন নিলো। একঘণ্টা ব্যাপী গুলি-পাল্টা গুলি চলতে থাকলো। গুলির শব্দে বেড়া উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধা দল আমাদের সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে এলো। এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। হানাদারেরা গুলি করা বন্ধ করলো। আমরাও অন্ধকারে গুলি করা বন্ধ করলাম। সারারাত আমরা না খেয়ে পজিশন অবস্থায় ছিলাম। আমাদের গ্রুপটি ছিলো বাবু রবীন্দ্র নাথ বাগ্‌চীর কমান্ডানাধীন। আমার বামপাশের এলএমজি চালাচ্ছিলেন কমান্ডার রবীন্দ্র নাথা বাগ্‌চী স্যার। আমার ডানপাশের থ্রি-নট-থ্রি চালাচ্ছিলেন আমার মেজো দাদা সমরেন্দ্র নাথ সান্যাল, তাঁর ডানপাশে আমার গ্রুপের অন্যান্যরা স্টেনগান ও থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল চালাচ্ছিলেন। যুদ্ধটি ছিলো ভীষণ ভয়াবহ সম্মুখ যুদ্ধ। তথাকথিত হিংস্র পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। 

সন্ধ্যার পর ওরা গুলি করা বন্ধ করলো, আমরাও গুলি করা বন্ধ করলাম। হয় যুদ্ধে বিজয়ী হতে হবে, অন্যথায় সবার জীবন যাবে। রাতে ধীতপুর সার গুদাম থেকে মাঝে মাঝে ২/১টা করে গুলি আসছিলো। ওদের গুলির প্রেক্ষিতে আমরা ২/১টা করে গুলি করছিলাম। ভোরে আলো ফুঁটলে আমাদের কমান্ডার বরীন্দ্র নাথ বাগ্চী ও বেড়ার কমান্ডার এস এম আমির আলী ও অন্যান্যরা স্ক্রোলিং করে ধীতপুর সার গুদামে এগিয়ে গেলেন। সার গোডাউনে গিয়ে দেখা গেলো, দুজন রাজাকার সারারাত কভারিং ফায়ার করেছে। কমান্ড করে রাজাকার দু’জনকে স্যারেন্ডার করানো হলো। তাদের কাছ থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে নেওয়া হলো। 

তাদের কাছ থেকে জানা গেলো, রাত ১১টার দিকে হানাদারেরা স্ক্রোলিং করে নিরাপদ দুরত্বে এসে হেঁটে বেড়া নদী পার হয়ে ঢাকা যাবার উদ্দেশ্যে পালিয়েছে। পরে জানা গেলো, পাকি হানাদারেরা বেড়া ঘাটে গিয়ে ভেড়াকোলা গ্রামের হলদারদের নৌকায় নদী পার হয়ে নগরবাড়ি ঘাট হয়ে ঢাকা যাবার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে।

ধীতপুরের যুদ্ধে বেড়ার এস এম আমির আলীর গ্রুপের বৃশালিকা গ্রামের জনাব আব্দুল খালেক ও ছেচানিয়া গ্রামের আমজাদ হোসেন শহিদ হয়েছেন এবং অন্যান্য গ্রুপের ৪ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়েছেন। স্থানীয় দু’জন পথচারী গোলাগুলির সময় গুলি লেগে ওয়াপদা বাঁধের উপর মারা গেছেন। ধীতপুর যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে আমরা জামিরতা হাই স্কুলে ক্যাম্প করে অবস্থান নিয়েছিলাম। ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ এ শাহজাদপুর উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়। মুক্তিযোদ্ধা প্রশাসন গড়ে উঠে। আব্দুল বাকি মির্জা শাহজাদপুর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাধিনায়ক ও থানা প্রশাসক মনোনীত হন। তিনি সিও (ডেভ) অফিসে বসতেন। শাহজাদপুর থেকে সারা উপজেলার মুক্তিযোদ্ধাদের সমস্ত খরচ বহন করতেন। ১০ জানুয়ারি’ ৭২ জাতির পিতা পাকিস্তানের কারাগার হতে মুক্ত হয়ে দেশে আসলেন। ১২ জানুয়ারি জাতির পিতা প্রথমে রাষ্ট্রপতি হিসেবে এবং পরক্ষণেই রাষ্ট্রপতি পদের ইস্তফা দিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রথা চালু করে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করলেন। জাতির পিতা আমাদেরকে অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। তাঁদের গ্রুপ ২৪ জানুয়ারি’৭২ রবিবার সিরাজগঞ্জ সদরের বিহারীর বাসায় অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের দায়িত্ব শেষ করেছিলেন। সরকার থেকে ন্যাশনাল মিলিশিয়া ক্যাম্প স্থাপন করা হলো। আমাকে ন্যাশনাল মিলেশিয়া ক্যাম্পে ভর্তির পরামর্শ দিলো। আমি ন্যাশনাল মিলিশিয়া ক্যাম্পে ভর্তি হলাম না। বাড়িতে চলে এলাম।

১০ ফেব্রুয়ারি’৭২ সিরাজগঞ্জ মহকুমা কার্যালয় থেকে কর্নেল জেনারেল এম এ জি ওসমানীর সনদ, একটি সাদা কম্বল ও বকেয়া পকেট ও রেশনিং মানি হিসেবে ১১০ টাকা দেওয়া হলো আমার পিতাকে। বাড়ি এসে রতন কান্দি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তাঁর বড় দাদা দেবেন্দ্র নাথ সান্যালের কাছ থেকে অষ্টম শ্রেণির অটোপাসের টিসি নিয়ে শাহজাদপুর বহুপার্শ্বিক উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়ে লেখাপড়া শুরু করেছিলেন আমার পিতা দেবেশ চন্দ্র সান্যাল।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও শিক্ষিকা।

লেখক পরিচিতি : সহকারি শিক্ষিকা, সরকারি আইডিয়াল প্রাইমারি স্কুল, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭।