অগ্রণী ব্যাংকে এক এলসিতেই ‘জালিয়াতি’ ৮৯০ কোটি টাকা!

অগ্রণী ব্যাংকে এক এলসিতেই ‘জালিয়াতি’ ৮৯০ কোটি টাকা!

বাঙলা কাগজ ডেস্ক : বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালার আলোকে এলসি (লেটার অব ক্রেডিট বা আমদানির ঋণপত্র) কমিশন বাবদ প্রতি ত্রৈমাসিকে সর্বোচ্চ শূন্য দশমিক ৪০ শতাংশ চার্জ নিতে পারে ব্যাংক। সর্বোচ্চ এ হার নির্ধারিত থাকলেও সরকারি প্রকল্পের আমদানিতে কখনও বিনা কমিশন কিংবা নামমাত্র কমিশনে এলসি খোলে রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকগুলো। তবে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সাবমেরিন বেস নির্মাণ প্রকল্পে অগ্রণী ব্যাংক ঘটিয়েছে উল্টো কাণ্ড। ৮ হাজার ৬৬১ কোটি টাকার এলসির বিপরীতে কমিশনের নামে শুধু অতিরিক্ত কেটে নিচ্ছে ৮৯০ কোটি টাকা। সবমিলিয়ে পাঁচ বছরে কাটা হবে ১ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা। এরই মধ্যে দুই কিস্তিতে ৬৫৩ কোটি টাকা নিয়েছে ব্যাংক। এখন তৃতীয় কিস্তির টাকা নেওয়ার সময় আটকে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চীনের পলিটেকনোলজিস থেকে সরকারি ওই প্রকল্পের সরঞ্জাম আমদানির জন্য অগ্রণী ব্যাংকের মতিঝিল বৈদেশিক বাণিজ্য শাখায় ১০ বছর মেয়াদি এলসি খোলা হয় ২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর। চীনা প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তির শর্ত অনুসারে এলসি মূল্য ১০ কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে। প্রতি কিস্তি পরিশোধের পর কমিশনের পরিমাণ কমার কথা। সে অনুযায়ী অগ্রণী ব্যাংক সর্বোচ্চ কমিশন নিতে পারে ৭৪৩ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। অথচ ব্যাংকটি পুরো এলসির ওপর ১০ বছরে ৪১ ত্রৈমাসিক হিসাব করেছে। এলসি মূল্য কমার বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে মূল এলসির ওপর প্রতি ত্রৈমাসিকে শূন্য দশমিক ৪০ শতাংশ হারে কমিশন হিসাব করে ১ হাজার ৬৩৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা ধার্য করেছে। শুধু তাই নয়, চীনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির আলোকে প্রথম কিস্তি পরিশোধের ১০৮ মাসের মধ্যে দশম কিস্তি দিতে হবে। প্রথম কিস্তি পরিশোধ হয় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে। সে অনুযায়ী এলসির মেয়াদ হওয়ার কথা ৯ বছর। কিন্তু অগ্রণী ব্যাংক এলসির মেয়াদ চার ত্রৈমাসিক বেশি নির্ধারণ করেছে। সবমিলিয়ে ব্যাংকটি সর্বোচ্চ হারের অতিরিক্ত কমিশন ধার্য করেছে ৮৮৯ কোটি ৫৬ লাখ টাকা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সর্বশেষ কিস্তি পরিশোধের পর এলসির কোনও কার্যক্রম থাকে না। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে এলসি খোলা হয়। ব্যাংক গ্যারান্টি দাখিল করা হয় ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে। ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম কিস্তির টাকা পরিশোধ করা হয়। এর মানে ১০ কিস্তি পরিশোধ হবে ২০২৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। আবার এলসির মেয়াদ ১০ বছর নির্ধারণ করা হলেও সব সরঞ্জাম আসবে পাঁচ বছরে। অগ্রণী ব্যাংকের দাবির আলোকে পুরো কমিশনের টাকা পাঁচ বছরে পাঁচটি কিস্তিতে পরিশোধ করা হচ্ছে। ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে পরবর্তী পাঁচ বছরে যা নিচ্ছে ব্যাংক। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম কিস্তির ৩২৬ কোটি ৭০ লাখ এবং ২০২১ সালের জানুয়ারিতে দ্বিতীয় কিস্তির ৩২৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা এরই মধ্যে নিয়ে গেছে।

এখন ২০২১-২২ অর্থবছরের তৃতীয় কিস্তির ৩২৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা চেয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিসে আবেদন করে অগ্রণী ব্যাংক। এ পর্যায়ে বাড়তি কমিশন নেওয়ার বিষয়টি ধরা পড়ায় তা আটকে দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, এলসির মাধ্যমে ব্যাংক আমদানি পণ্যের মূল্য পরিশোধের দায় তথা ঝুঁকি নেয়। প্রতিটি কিস্তি পরিশোধের পর ঝুঁকি কমে বিধায় কমিশনও কমবে। প্রতি কিস্তিতে পরিশোধিত অংশ বাদ দিয়ে কমিশন হিসাব হবে। ব্যাংকিং পরিভাষায় যা রানডাউন ভ্যালু হিসেবে বিবেচিত। অগ্রণী ব্যাংকের শাখার বিবরণীতেও এ পদ্ধতিতে দায় হিসাব করা হয়েছে। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শিডিউল অব চার্জেস নীতিমালায় এলসির বিপরীতে প্রতি ত্রৈমাসিকে সর্বোচ্চ শূন্য দশমিক ৪০ শতাংশ হারে কমিশন নেওয়ার বিধান রয়েছে। এলসি কমিশনের সর্বোচ্চ এ হার নির্ধারিত থাকলেও সাধারণভাবে দরকষাকষির মাধ্যমে তা নির্ধারিত হয়। নৌবাহিনীর মাধ্যমে বাস্তবায়নাধীন এই প্রকল্পে দরকষাকষির কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় নি। ফলে রানডাউন ভ্যালু বিবেচনায় প্রতি কিস্তিতে ব্যাংক সর্বোচ্চ ১৪৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকা নিতে পারে। এ হিসাবে প্রথম দুই কিস্তিতে ২৯৭ কোটি ৫৮ লাখ টাকার বেশি নেওয়ার সুযোগ নেই। যদিও ব্যাংকটির অযৌক্তিক দাবি অনুযায়ী দুই কিস্তিতে ৬৫৩ কোটি ৪১ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। পুরো অর্থ পরিশোধ না হওয়ায় পরবর্তী ৩ কিস্তিতে অতিরিক্ত অর্থ সমন্বয় করতে হবে। সবমিলিয়ে অগ্রণী ব্যাংক শেষ কিস্তিতে গিয়ে ৯০ কোটি ৫৬ লাখ নিতে পারবে।

জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিসের পর্যবেক্ষণে অতিরিক্ত কমিশন কাটার বিষয়টি ধরা পড়ার পর এ বিষয়ে মতামতের জন্য পাঠানো হয় ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগে। এ বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, এলসিটি দীর্ঘমেয়াদি এবং মূল্যমান ৮ হাজার ৬৬১ কোটি টাকা। ফলে সর্বোচ্চ হারে কমিশন নির্ধারণ কোনোভাবেই যৌক্তিক হতে পারে না। সরকারি অন্য যেসব এলসি কমিশন দরকষাকষির মাধ্যমে নির্ধারিত হয়ে থাকে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিস এ ক্ষেত্রেও কমিশন নির্ধারণ করতে পারে। আর একাধিক কিস্তিতে পরিশোধযোগ্য এলসির ক্ষেত্রে প্রতিটি কিস্তি পরিশোধের পর সম্পূর্ণ পরিমাণের ওপর কমিশন নির্ধারণ কোনোভাবেই সমীচীন নয়। বিভিন্ন পর্যায়ে পর্যালোচনা শেষে নিয়ম মাফিক কমিশন হার নির্ধারণের নির্দেশনা দিয়ে গত এপ্রিলে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে চিঠি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। চিঠি পাওয়ার ১০ কর্মদিবসের মধ্যে আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির আলোকে এলসির মেয়াদ হিসাব করে পুনরায় কমিশন দাবির আবেদন করতে বলা হয়। ব্যাংকের কাছ থেকে যথাসময়ে জবাব না পেলে নিয়ম অনুযায়ী একতরফা ব্যবস্থা নেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয় ওই চিঠিতে। জবাব দেওয়ার জন্য দুই মাস সময় নেয় ব্যাংক। সে অনুযায়ী, সম্প্রতি একটি জবাব দিয়ে নিজেদের পক্ষে বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরেছে অগ্রণী ব্যাংক।

জানতে চাইলে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম বলেন, আমাদের হিসাব পদ্ধতি ভুল না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আপত্তির জবাব দিয়ে ইতোমধ্যে চিঠি লেখা হয়েছে। আমাদের জবাব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যালোচনাধীন রয়েছে। প্রথম দুই কিস্তির টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি। এটা এমন না যে, অন্যভাবে আমরা কেটে নিয়েছি। তিনি বলেন, সাধারণভাবে এলসি খোলার সঙ্গে সঙ্গে কমিশনের টাকা কেটে আদায় করা হয়। তবে এতো বড় এলসিতে একবারে কাটা হলে চাপ পড়বে বিধায় ৫ বছরে ৫টি কিস্তিতে কমিশনের টাকা নেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, সরকারি এলসিতে এভাবে সর্বোচ্চ হারে কমিশন আরোপ অনৈতিক। সেখানে সর্বোচ্চ হারে কমিশন আরোপেই সীমাবদ্ধ না থেকে পরিশোধ হওয়া অংশের ওপরও প্রতি ত্রৈমাসিকে কমিশন আরোপ করেছে। ব্যাংকিং নিয়মে এর কোনও সুযোগ নেই। ফলে বাড়তি নেওয়া সার্ভিস চার্জ এখন সমন্বয় করতে হবে।

সংশ্নিষ্টরা জানান, সরকারি প্রকল্পের এলসি রাষ্ট্রীয় ব্যাংকে খোলার প্রধান উদ্দেশ্য থাকে কম কমিশন দেওয়া। এর বড় উদাহরণ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। টাকার অংকে দেশের সবচেয়ে বড় এই প্রকল্প নির্মাণে প্রায় ৯৬ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ ১ হাজার ১৩৮ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়। ২০১৭ সালের নভেম্বরে খোলা এলসির মেয়াদ ২০২৪ সাল পর্যন্ত। এই এলসির বিপরীতে এখনও এক টাকাও কমিশন পায় নি সোনালী ব্যাংক। ব্যাংকটির দাবির প্রেক্ষিতে পারমাণবিক শক্তি কমিশনের তরফ থেকে ২০ কোটি টাকা কমিশন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও এখনও এক টাকাও পায় নি ব্যাংকটি। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় পড়া রাশিয়া থেকে এ আমদানিতে অনেক বেশি ঝুঁকি নিয়ে কাজ চালিয়ে নিচ্ছে ব্যাংকটি। সংশ্লিষ্টরা এমনটিই দাবি করেছেন।

জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আতাউর রহমান প্রধান বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের এলসিতে শূন্য দশমিক ৪০ শতাংশ হারে কমিশন হিসাব করলে সোনালী ব্যাংক প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা পেতো। তবে ২০ কোটি টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।