৫১ বছর ধরে অসহায় শহিদ ‍মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী আনোয়ারা!

৫১ বছর ধরে অসহায় শহিদ ‍মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী আনোয়ারা!

নিজস্ব প্রতিবেদক, বাঙলার কাগজ ও ডন; লিয়াকত হোসেন, রাজশাহী : রাজশাহীতে একজন শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীর দিন কাটছে অর্ধাহার আর অনাহারে! এক্ষেত্রে ৫১ বছরেও মেলে নি তাঁর স্বামীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। বলছিলাম শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা জলিল শাহ’র স্ত্রীর কথা। বর্তমানে জলিল শাহের স্ত্রী বৃদ্ধা আনোয়ারা বেওয়ার দিন কাটছে বড়ই করুণ অবস্থায়।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবনের সবকিছু হারিয়ে দুঃখ-কষ্ট নিয়েই অসহায় জীবন কাটাচ্ছেন নিঃসন্তান আনোয়ারা বেওয়া। আনোয়ারার বাড়ি কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলায়। তিনি রাজশাহী মহানগরীর তালাইমারি এলাকায় বাদুরতলা বধ্যভূমির পাশে পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গায় বসবাস করছেন। তাঁর ঘরটিও জরাজীর্ণ-ভাঙাচোরা।

গত ক’দিন ধরেই শীত হানা দিচ্ছে তাঁর এই ঝুপড়ি ঘরে। তাঁর দিন চলছে অসুস্থতা নিয়েও। অর্থের অভাবে চিকিৎসাটা করাতে পারছেন না তিনি।

দেশ স্বাধীনের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া দুই হাজার টাকা ছাড়া বিজয়ের এতো বছরেও মেলে নি আর কোনও সহায়তা। এমনকি কোনও শীতবস্ত্রও নেই তাঁর। চোখের সমস্যাটাও বেড়েছে।

আনোয়ারা বেওয়ার স্বামী জলিল শাহ মুক্তিযুদ্ধ করতে করতে নিজের প্রাণটিই দেশের জন্য বিলিয়ে দিয়েছেন। অথচ আমরা তাঁর পরিবারের একটি সদস্যকেই দেখভাল করতে পারছি না- আক্ষেপ করে বললেন এলাকার লোকজন।

এমন অবস্থায় ৮০ বছর বয়সেও আনোয়ারা দু বেলা দু মুঠো খাবারের জন্যও ছুটে বেড়ান অন্যের দুয়ারে-দুয়ারে। তাঁর সহায়-সম্বল বলতে নড়বড়ে ঘুনেধরা একটি চৌকি, থালাবাটি আর একটি বাক্স। জীবনযুদ্ধে হাপিয়ে পড়া এ মানুষটি আজ বড়ই অসহায়।

মাত্র ১৪ বছর বয়সেই বিয়ে হয়েছিলো আনোয়ারা বেওয়ার। সে সময় সবকিছুই ছিলো তাঁর। স্বামী ব্যবসা করতেন। নগরীর তালাইমারি বাদুরতলা এলাকাতেই ছিলো তাঁদের দোতলাবাড়ি। এখন এসব শুধুই স্মৃতি। কারণ বাড়িটি দখল হয়ে গেছে। এখন সেখানে বাস করছে অন্যরা।

স্বামীকে নিয়ে সুখ-শান্তিতেই দিন কাটছিলো আনোয়ারার। কিন্তু সেই সুখ বেশিদিন টেকে নি। বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করার লক্ষ্যে সেদিন বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বুলেট কেড়ে নেয় জলিল শাহের প্রাণ। নিমিষেই নিভে যায় আনোয়ারার সুখের প্রদীপ। সেদিনের সেই দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে নিঃসঙ্গতায় আজো বেঁচে আছেন আনোয়ারা।

পাকিস্তানি হায়েনাদের হাত থেকে বাঁচাতে স্ত্রীকে রেখে এসেছিলেন দূর্গাপুরের এক আত্নীয়ের বাড়িতে। শেষ দেখায় বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুসহ দেশকে বাঁচাতে যাচ্ছি। হয়তো আর দেখা হবে না। সেদিনের সেই কথাগুলো আজও স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠে আনোয়ারার।

স্থানীয়রা আরও জানান, নগরীর তালাইমারি শহিদ মিনারের পাশে শহিদদের নামফলক রয়েছে। সেখানে থাকা ‘সাবেক ১ নম্বর ওয়ার্ডের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মুক্তিযুদ্ধে শহিদ’দের নামের তালিকায় শহিদ ‘জলিল শাহ’ নামটি আছে ৬ নম্বরে। জলিল শাহ মুক্তিযুদ্ধে নিহত হওয়ার বিষয়টি সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. আব্দুল মান্নানসহ স্থানীয়রা বাঙলার কাগজ ও ডনকে নিশ্চিত করেছেন। 

শহিদ মুক্তিযোদ্ধা স্বামীর সম্মানে দ্বিতীয় বিয়ে পর্যন্ত করেন নি আনোয়ারা। তাই বৃদ্ধ বয়সে দেশপ্রেমিক স্বামীর উপযুক্ত মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তিনি বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। তিনি তাঁর স্বামীর মর্যাদা, তাঁর বাড়িটি উদ্ধার এবং তাঁকে দেখভালের আকুতি জানিয়েছেন।

স্থানীয়দের দাবি, শহিদ জলিল শাহের স্ত্রী আনোয়ারার অন্তত সরকারিভাবে একটা ব্যবস্থা হোক। দেশ স্বাধীনের পরে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া কৃতজ্ঞতাপত্র আর দুই হাজার টাকা পেয়েছিলেন তিনি। তবে সেই কৃতজ্ঞতাপত্রটি যদিও হারিয়ে ফেলেছেন, কিন্তু নামফলক তাঁর মুক্তিযোদ্ধা স্বামীর পরিচয় দেয়। তারপরেও এতো বছরে তিনি পান নি কোনও সহায়তা। হতে পারে তিনি বিভিন্ন জায়গায় দৌড়াদৌড়ি করতে পারেন নি বলে এখনও তাঁর স্বামীর নাম মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয় নি। অথচ তাঁর স্বামী মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হয়েছিলেন, তাই এ নাম সবার আগেই অন্তর্ভুক্ত হওয়ার প্রয়োজন ছিলো।

স্থানীয়রা আরও জানান, নগরীর তালাইমারি বাদুরতলা এলাকাতেই ছিলো তাঁদের দোতলা বাড়ি। কিন্তু বাড়িটি এখনও টিকে থাকলেও, তাতে বসবাস করেন অন্যরা।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে আনোয়ারা বেওয়া জানান, আমার স্বামী মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হন। তাঁর লাশটিও আমি দেখতে পারি নাই। কিন্তু আজও তাঁকে শহিদ মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি। এমনকি শহিদ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হিসেবে সরকার থেকে আমি কোনও সাহায্য-সহযোগিতাও পাই না।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘ডিসেম্বর আসলে খালি (শুধু) সাংবাদিকরা আসে। তাঁরা এই বৃদ্ধার মুখের কথা শুনে। পেপার-পত্রিকায় আসে। কোনও লাভ হয় না। তারপরে আর তাঁদের দেহি না।’

স্থানীয় আলম হোসেন বাঙলার কাগজ ও ডনকে জানান, শহিদ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হিসেবে তিনি এমনিতেই সরকারি অনুদান পাওয়ার কথা। তিনি এই বয়সে কারও বাড়িতে কাজ করতেও পারছেন না। তাঁকে সাহায্য-সহযোগিতা করার মতো আপনজনও কেউ নেই। তিনি যেনো সরকারিভাবে দ্রুততম সময়ের মধ্যেই সহায়তা পান, এ দাবি জোরালোভাবে জানাই।

সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. আব্দুল মান্নান বাঙলার কাগজ ও ডনকে বলেন, ‘এখনই সময় আনোয়ারার জন্য কিছু করার। তাঁর পাশে এসে দাঁড়াতে সরকার এবং বিত্তবানদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’

কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা নেতা বাঙলার কাগজ ও ডনকে বলেছেন, এখনই সময় আনোয়ারাদের জন্য কিছু করার। তাঁদের পাশে যদি দেশ না দাঁড়ায়, তাহলে সেটি অন্যায় হবে।

কয়েকজন এলাকাবাসী বাঙলার কাগজ ও ডনকে বলেন, দীর্ঘ নয়মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ। কিছুদিন আগেই আমরা উদ্‌যাপন করলাম স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। আর ১৬ ডিসেম্বর আমরা উদ্‌যাপন করলাম বিজয়ের ৫১তম বছর। 

‘বাংলাদেশের ইতিহাস হলো স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য কয়েক কোটি খেটে-খাওয়া মানুষের সুদীর্ঘ লড়াইয়ের ইতিহাস। আজকের এই মুক্তি ও স্বাধীনতা বাঙালির দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন ও সাধনার ফসল।’

‘তাহলে কি প্রমত্তা পদ্মার পানে শুধুই নীরবে-নিভৃতে চেয়ে থাকা? আমাদের বিজয়ের আনন্দ-উল্লাসের ধ্বনিতে হারিয়ে যাবে আনোয়ারা বেওয়ার হাহাকার! নাকি আমরা তাঁর জন্য কিছু করতে পারলে তবেই আমাদের স্বাধীনতা ও বিজয় পরিপূর্ণ হবে?’