৪১ জনের লাশ উদ্ধার , ১৬ জনের শনাক্ত। আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে চট্টগ্রাম মেডিক্যালের পরিবেশ।

৪১ জনের লাশ উদ্ধার , ১৬ জনের শনাক্ত। আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে চট্টগ্রাম মেডিক্যালের পরিবেশ।

নিজস্ব সংবাদদাতা, বাঙলা কাগজ; চট্টগ্রাম : সীতাকুণ্ডে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে আগুনের পর ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় নিখোঁজদের সন্ধানে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে ভিড় করেছেন তাঁদের স্বজনেরা। আর কর্তৃপক্ষ লাশ বুঝিয়ে দিতে পারছেন না, কারণ অধিকাংশ লাশই শনাক্ত করা যাচ্ছে না। সবমিলিয়ে আহত ও নিহতদের স্বজনদের আহাজারি আর কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে হাসপাতালের পরিবেশ। এ অবস্থায় পুলিশ জানিয়েছে, বেলা ৩টা পর্যন্ত ৪১ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, আর শনাক্ত করা হয়েছে ১৬ জনের লাশ।

নগরী থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে কদমরসুল এলাকার ওই ডিপোতে শনিবার (৪ জুন) রাতে আগুন লাগার পর সাড়ে ১০টার সময় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটলে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

পরে আজ রোববার (৫ জুন) বেলা ৩টা পর্যন্ত পুরোপুরি নেভানো সম্ভব হয় নি আগুন।

সীতাকুণ্ডে উদ্ধার তৎপরতা শুরুর পর রাত ১২টার দিকে অ্যাম্বুলেন্সে করে আহতদের হাসপাতালে আনা শুরু হয়। এক পর্যায়ে রোগীর চাপ বেড়ে গেলে এন্ট্রি করা বাদ দেওয়া হয়।

চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই আলাউদ্দিন তালুকদার বাঙলা কাগজ ও ডনকে জানান, রোববার দুপুর পর্যন্ত মোট ৩৭ জনের মরদেহ মর্গে এসেছে। দগ্ধ ও আহত শতাধিক ব্যক্তিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বহু মানুষ এখনও নিখোঁজ রয়েছেন।

মেডিক্যাল কলেজের বারন্দায় দাঁড়িয়ে কলেজছাত্রী সূচনা (২০) বাঙলা কাগজ ও ডনকে জানান, নিখোঁজ বড় ভাই শাহজাহনের খোঁজে বাবা তাজুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন তিনি।

তাঁদের বাড়ি ফটিকছড়িতে, চট্টগ্রামে তাঁরা থাকেন শহরের মনসুরাবাদ এলাকায়। ট্রাক চালক শাহজাহান পণ্য নিয়ে ডিপোতে গিয়েছিলেন শনিবার রাতে। আগুন লাগার আগে মোবাইল ফোনে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে শেষবার কথা হয় বলে জানান সূচনা।  

তিনি বলেন, ‘আমরা রাতে এই ঘটনা জানতাম না, সকালে জানতে পেরেছি। সকাল থেকেই ভাইয়ের ফোন বন্ধ পাই। ডিপোতে ট্রাক আছে, ভাই নেই।’

রোববার ভোর থেকে সূচনাদের মতো অনেকেই নিখোঁজ স্বজনদের খোঁজে হাসপাতালে ভিড় করতে শুরু করেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওয়ার্ড আর বারান্দায় সেই ভিড়ও বাড়তে থাকে। অনেকে নগরীর বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও খোঁজাখুঁজি করেন।

হাসপাতালের জরুরি বিভাগের গেইটে কোনও অ্যাম্বুলেন্স এসে দাঁড়ালেই সেটির কাছে ছুটে যাচ্ছেন স্বজনেরা। আবার সংবাদকর্মী বা পুলিশ সদস্যদের সামনে গিয়ে হাতের মোবাইল থাকা ছবি দেখিয়ে জানতে চাইছেন স্বজনের খোঁজ।  

পঞ্চাশোর্ধ আলী নেওয়াজ জানালেন রাত থেকে ছোট ভাই আবদুর রহমানকে ফোনে না পেয়ে বাঁশখালী থেকে ভোরে নগরীতে ছুটে এসেছেন তিনি।

আলী নেওয়াজ বাঙলা কাগজ ও ডনকে বলেন, রহমান কন্টেইনার ডিপোতে আট বছর ধরে কাজ করেন। শনিবার রাতে ডিপোতে আগুন লাগার পর ভিডিও কলে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে আগুনের বিষয়টি জানিয়েছিলেন। এরপর থেকেই তাঁর মোবাইল বন্ধ।

আলী নেওয়াজ বলেন, ‘হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে খোঁজ নিয়েছি, পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালগুলোতেও খোঁজ নিয়েছি কিন্তু কোথাও পাই নি।’

শনিবার মালামাল নিয়ে ডিপোতে গিয়ে বিস্ফোরণের পর নিখোঁজ হন কভার্ড ভ্যান চালক সুমন। তাঁর বাড়ি নোয়াখালীর সোনাপুর। ছোট ভাই আর বোনকে নিয়ে শহরের নিমতলা এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন সুমন।

বিস্ফোরণের পর ভাইয়ের সন্ধান না পেয়ে হাসপাতালে আসা তাঁর ছোট ভাই মানুন বলেন, ‘রাতে ডিপোতে আগুন লাগার পর আমাকে ফোন করে জানালো। কিন্তু পরে ফোন করে আর পাই নি। মোবাইল বন্ধ পাচ্ছি। সকালে হাসপাতালে আসলাম, বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঘুরে ঘুরে কোথাও পেলাম না।’

চট্টগ্রাম শহরের কলসিদীঘি পাড় এলাকার মো. ফারুক ওই ডিপোতে ট্রাকে মালামাল তোলা-নামানোর কাজ করেন। আগুন ও বিস্ফোরণের পর তিনিও নিখোঁজ বলে জানালেন তাঁর মেয়ে ফাতেমা বেগম (২৪)।

ইপিজেড এলাকার একটি পোশাক কারখানার কাজ করা ফাতেমা কাঁদতে কাঁদতে বাঙলা কাগজ ও ডনকে বলেন, দুর্ঘটনার পর রাতেই ডিপো এলাকায় গিয়ে বাবাকে তিনি খুঁজেছেন। সেখানে না পেয়ে সকাল থেকে হাসপাতালে বসে আছেন বাবার খবর পেতে।

এদিকে তোহা নামে একজনের খোঁজে হাসপাতালে ঘুরছেন তাঁর ফুপাতো ভাই মিজান।

তিনি বাঙলা কাগজ ও ডনকে জানান, বাঁশখালীর নাপোড়ার তোহা কন্টেইনার ডিপোর ক্রেইন অপারেটর। আগুন লাগার পর থেকে তোহার কোনও খোঁজ পাচ্ছেন না তাঁরা।

মিজান বলেন, শনিবার রাতে আগুন লাগার খবর পেয়ে প্রথমে ডিপো এলাকায় গিয়ে তোহাকে খুঁজেছেন তাঁরা। কিন্তু সেখানে না পেয়ে হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঘুরেছেন, ভাইকে পান নি।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক আনিছুর রহমান বাঙলা কাগজ ও ডনকে জানান, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা গেলেও বারবার বিস্ফোরণে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ডিপোতে রাসায়নিক থাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হয়।