৪০০ আমগাছ এক রাতে কেটে ফেললো দুর্বৃত্তরা!

৪০০ আমগাছ এক রাতে কেটে ফেললো দুর্বৃত্তরা!

নিজস্ব প্রতিবেদক, বাঙলার কাগজ ও ডন; রাজশাহী : করাত দিয়ে কাটা ১৮ বছর বয়সী আমগাছের গোড়ায় বসে বিলাপ করছেন চাষি আবু সামা (৪৫)। তাঁর এমন ২৮টি গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। গাছগুলো তাঁর কাছে সন্তানের মতো। আবু সামা বলেন, ‘একটা ছেলে যেভাবে মানুষ করতে হয়, একটা আমগাছও সেই রকম যত্ন করলেই বাঁচে।’

রাজশাহীর বাঘা উপজেলার হাবাসপুর গ্রামে আবু সামার মতো ১৫ চাষির প্রায় ৪০০ আমগাছ এক রাতে কেটে ফেলেছে দুর্বৃত্তরা। সোমবার (১২ ডিসেম্বর) সকালে উঠে কাটা গাছগুলো দেখে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকেরা। মাঠ থেকে বাড়ির সামনে কাটা গাছ এনে ফেলা হচ্ছে, আর চাষিদের পরিবারের সদস্যরা আহাজারি করছেন। হুট করে হাবাসপুর গ্রাম যেন শোকের গ্রামে পরিণত হয়েছে।

এ ঘটনায় চাষি আবু সামা ও সাধন কুমার প্রামাণিক বাদি হয়ে সোমবার সকালে রাজশাহীর বাঘা থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন। তবে এজাহারে তাঁরা কারও নামোল্লেখ করেননি। এর আগেও গাছ কাটার ঘটনা ঘটেছিল। কারা, কী কারণে গাছগুলো কেটেছে, কেউ কিছু বলতে পারছেন না।

বাঘার আমবাগানসমৃদ্ধ এলাকা হাবাসপুর। এ গ্রামের প্রায় সব জমিতে আমগাছ রয়েছে। এমনকি বাড়ির আঙিনায় রয়েছে আমগাছ। যে গাছগুলো কাটা হয়েছে, সেগুলো অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকায় লাগানো হয়েছিল। আগে এ জমিতে শুধু ধান চাষ করা হতো।

বাঘা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাজ্জাদ হোসেন জানান, গাছ কাটার লিখিত অভিযোগ পেয়েছেন। পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সোমবার দুপুরে হাবাসপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তা দিয়ে ভ্যানে করে বাগানের মালিকেরা কাটা গাছের ডালপালা বাড়িতে নিয়ে আসছেন। বাড়ির সামনে গাছের ডাল ফেলার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের লোকজন বের হয়ে আহাজারি শুরু করছেন। প্রবীর সরকারের প্রায় ১৮ বছর বয়সী ১৮টি আমগাছ কেটে ফেলা হয়েছে। সেই গাছের ডালপালা বাড়ির সামনে এনে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর স্ত্রী রীতা সরকার ‘হায় হায়’ করে বুক চাপড়াতে লাগলেন। প্রবীর সরকার বলছেন, ‘মাঠে যায়ি দেকি মাঠ সাফ কইরি দিচে।’

মাঠ থেকে ভ্যানে গাছের ডালপালা তুলে দিয়ে পেছনে পেছনে বাইসাইকেল নিয়ে হেঁটে আসছিলেন নিপেন্দ্রনাথ প্রামাণিক (৬৭)। তিনি মুঠোফোনে তার স্ত্রীকে গাছগুলো নামিয়ে নিতে বলছেন আর চোখ মুছছেন। তিনি বলেন, তাঁর তিন ভাইয়ের ১৮টি গাছ কেটেছে। তাঁদের কারও সঙ্গে কোনো শত্রুতা নেই। প্রায় ১৭ বছর বয়সী গাছগুলোর কোনোটিতে ৪ মণ, কোনোটিতে ৫ মণ আম আসে। সকালে মাঠে গিয়ে দেখেন, বাগানের ১৮টি গাছ গমখেতের মধ্যে পড়ে আছে। খবর পেয়ে পুলিশ এসেছিল। সব লিখে নিয়ে গেল। কিন্তু কিছুতেই নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারছেন না তিনি।

সাধন কুমার প্রামাণিকের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর বৃদ্ধ বাবা সন্তোষ কুমার প্রামাণিক গাছের ডালপালা নিয়ে বাড়ির সামনে বসে রয়েছেন। তিনি প্রায় কথা বলতে পারছেন না। তাঁর নিজের ১৫টি আর ছোট ভাই রিপনের ১৫টি গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। গাছগুলোর বয়স ১৭ বছর হয়েছে। প্রতিটি গাছে প্রায় ৫ মণ করে আম ধরে।

সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে আবু সামা মাঠে নিয়ে গেলেন। মাঠে নামার রাস্তার মুখেই দেখা গেল, চাষি হাফিজুল তাঁর কাটা গাছ টেনে তুলছেন। মাঠের মধ্যে গিয়ে দেখা গেল, কোনো গাছের ডালপালা নেই, কোনোটার গোড়া কেটে দেওয়া হয়েছে। গাছটি শুয়ে পড়েছে। প্রায় ৩২ বিঘার মাঠজুড়ে একই দৃশ্য। কোনোটার ডালপালা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, শুধু কাটা গোড়া দেখা যাচ্ছে। আর কোনোটা এখনো মাঠে পড়ে রয়েছে।

আবু সামা একটি গাছের গোড়া ধরে বসে বিলাপ করতে লাগলেন। তিনি বললেন, কয়েক বছর আগে এ মাঠেই এক রাতে তাঁর ২০টি গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। তাঁর বিচার আজও পান নি। সেই আসামিও ধরতে পারেন নি। এবার আবার সেই ঘটনা ঘটল। কেউ বলতে পারছে না, কে এ কাজ করেছে।

আবু সামার বাগানের পাশে সোলায়মান হোসেনের স্ত্রী রূপজান বেগমকে পাওয়া গেল। তাঁর স্বামী একজন প্রতিবন্ধী। রূপজান ‘হায় হায়’ করে মাঠের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় ছোটাছুটি করছেন।

কাটা গাছ দেখে একজন ব্যাপারী এসেছেন গাছ কিনতে। আবু সামা বললেন, ‘আজ আমি কিছুতেই গাছে হাত দিতে পারব না। থাক, আমার গাছ পড়ে থাক।’

স্থানীয় মনিগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘লোকমুখে শুনে আমি বাগানে গিয়েছিলাম। ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক। দুর্বৃত্তদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা হবে। সেই চেষ্টা করা হবে।’