‘১২২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ’ বৃষ্টি! উদ্ধারের আশায় মানুষ।

‘১২২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ’ বৃষ্টি! উদ্ধারের আশায় মানুষ।

নিজস্ব প্রতিবেদক, বাঙলা কাগজ; সিলেট : সিলেট বিভাগের ৮০ শতাংশ এলাকা এখন উজান থেকে আসা ঢলের কারণে পানির নিচে। এর মধ্যে সুনামগঞ্জের ৯০ শতাংশ এলাকা ডুবে গেছে। বাকি দুই জেলা শহর হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের উঁচু স্থান, পাহাড়ি এলাকা এবং ভবন ছাড়া সবখানে এখন পানি। আগামী দুই দিনে এই পানি আরও বাড়তে পারে বলেই জানিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।

প্রকৃতপক্ষে সিলেট ও সুনামগঞ্জে কতো লোক দুর্গত হয়ে পড়েছেন, তার সঠিক হিসাব করা এখন অনেকটা কঠিন। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে পড়ায় অনেক স্থানে মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। সিলেটের লামাকাজিসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষকে উদ্ধারের জন্য এলাকাবাসী আর্তনাদ করছেন। সিলেট নগরীর আখালিয়া এলাকায় দেখা যায়, পশ্চিম দিকে সুনামগঞ্জমুখী রাস্তা দিয়ে ট্রাক ভর্তি বানভাসি মানুষ সিলেট নগরীতে উঠছেন। ভয়াবহ পরিস্থিতি ও বানবাসীর অসহায়ত্ব আসলে লিখে শেষ করা যাবে না। অথবা বুঝানোও সম্ভব নয়।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, ১৯৯৮ সালের জুন মাসে সিলেট বিভাগে অনেকটা এমন বন্যা হয়েছিলো। কিন্তু এরপর বেশিরভাগ বন্যা মূলত হাওর ও সুনামগঞ্জের নিম্নাঞ্চল পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিলো। ২০১৯ সালে সুনামগঞ্জ ও সিলেট শহরে দুই-তিন দিনের জন্য হঠাৎ বন্যা হয়। কিন্তু পুরো সিলেট বিভাগের বেশিরভাগ এলাকা প্লাবিত হওয়ার মতো বন্যা হয় নি। 

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভুঁইয়া বাঙলা কাগজ ও ডনকে বলেন, দেশের একটি বিভাগের প্রায় ৮০ শতাংশ ডুবে যাওয়ার মতো বন্যা এর আগে বাংলাদেশে হয় নি। সিলেটে এর আগে যতো বন্যা হয়েছে, তা মূলত হাওর এলাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো। কিন্তু এবার গ্রাম, শহর ও উঁচু এলাকাও পানির নিচে চলে গেছে। সোমবারের আগে এই পানি নামার সম্ভাবনা কম। কারণ, উজানে আগামী দুই দিন অতিভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস আছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভূ-উপগ্রহভিত্তিক সংস্থা সিএমডব্লিইউ’র পূর্বাভাস অনুযায়ী, শনিবার (১৮ জুন) বাংলাদেশের উজানে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ৫ শ থেকে ৬ শ মিলিমিটার বৃষ্টি হতে পারে। এর আগে গত ২৪ ঘণ্টায় সেখানে ৯৭২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। যা ১২২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বৃষ্টি। আর গত তিন দিনে সেখানে প্রায় আড়াই হাজার মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এ সময় সিলেট ও সুনামগঞ্জে দেড় হাজার মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে বলেই পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন। এই অল্প কয়েক দিনে এতো বৃষ্টির রেকর্ডও গত ১ শ বছরেও নেই।

বাংলাদেশের নদী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিলেট বিভাগের সুরমা, কুশিয়ারা এবং গোয়াইনসহ বেশিরভাগ নদ-নদীতে পলি পড়ে অনেক এলাকা ভরাট হয়ে গেছে। নদ-নদীর বুক উঁচু হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টির পানির ঢল ধরে রাখতে পারছে না। ফলে পানি উপচে দ্রুত বসতি ও শহর এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে।

হাওর এলাকায় কৃষিকাজসহ নানা তৎপরতার কারণে পানি ধারণের ক্ষমতা কমে গেছে। যে কারণে বন্যার পানির উচ্চতা বেড়ে গেছে। 

যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, শুক্রবার (১৭ জুন) সকাল ৬টায় সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদের সামনে সুরমা নদীতে সেকেন্ডে ১২ হাজার ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হচ্ছিলো। পানির উচ্চতা বিপৎসীমার প্রায় ১ মিটার ওপরে ছিলো। স্বাধীনতার পর দেশের ওই এলাকায় এতো উঁচু দিয়ে এবং এতো বিপুল পরিমাণে পানি আসে নি।

এ ব্যাপারে কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মোস্তফা কামাল বাঙলা কাগজ ও ডনকে বলেন, চেরাপুঞ্জিসহ আশপাশের এলাকাগুলো এমনিতেই বিশ্বের সবচেয়ে বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা। এবার বঙ্গোপসাগর বেশি উত্তপ্ত থাকায় মেঘ ও মৌসুমী বায়ু বেশ শক্তিশালী ছিলো। যে কারণে বৃষ্টি বেশি হচ্ছে। ফলে এবারের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের নদীগুলোকে দ্রুত খনন করে এর পানি ধারণের ক্ষমতা বাড়াতে হবে। নয়তো প্রায় বছর আমাদের এ ধরনের বন্যার মুখে পড়তে হবে।

সিলেটে বন্যার্তদের নগদ ৭০ লাখ টাকা ও ৮ হাজার ব্যাগ শুকনো খাবার বরাদ্দ : বন্যার্তদের সহায়তায় নতুন করে আরও খাবার ও নগদ অর্থ বরাদ্দ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিলেট-১ আসনের এমপি ড. এ কে আব্দুল মোমেন। সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন বলেও জানান তিনি। শুক্রবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, সিলেটের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি বিবেচনায় বন্যার্ত মানুষের মাঝে নগদ ২০ লাখ টাকা ও ৮ হাজার ব্যাগ শুকনো খাবার বরাদ্দ দিয়েছে ত্রাণ মন্ত্রণালয়। এর আগে সাড়ে ৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন জানান, ইতোমধ্যে বন্যার্তদের উদ্ধার তৎপরতায় মাঠে নেমেছে সেনাবাহিনী। শুক্রবার সকাল থেকে সিলেট ও সুনামগঞ্জের ৮টি উপজেলায় সেনাবাহিনীর ৮টি ব্যাটালিয়ন পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধারে কাজ শুরু করেছে। সিলেট সদর, কোম্পানীগঞ্জ, সুনামগঞ্জের ছাতক, দোয়ারাবাজার, দিরাই, জামালগঞ্জ উপজেলাসহ মোট ৮টি উপজেলায় কাজ করছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। পর্যাপ্ত নৌকা ও উদ্ধারকর্মী না থাকায় সুনামগঞ্জ শহরেই অনেকেই ঘরের ভিতরে আটকা আছেন। তাঁরা এখন উদ্ধারের আশায়।