শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগে স্বজনপ্রীতি!

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগে স্বজনপ্রীতি!

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ : শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শেকৃবি) চাকরি প্রদানে উপাচার্যদের আত্মীয়প্রীতি দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছে। উপাচার্য হলেই তার সন্তানসহ নিকটাত্মীয়দের নিশ্চিত চাকরি মেলে। শুধু উপাচার্য নয়, উপ-উপাচার্য বা কোষাধ্যক্ষদের প্রায় একই সুবিধা নেওয়া এখন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। ২০০১ সালে বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে প্রতিষ্ঠালাভের পর যে কজন উপাচার্য দায়িত্ব পালন করেছেন অধিকাংশের ক্ষেত্রেই আত্মীয় থেকে শুরু করে এলাকার অযোগ্য ব্যক্তিকেও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

সম্প্রতি সেকশন অফিসার হিসেবে চাকরি পেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শহীদুর রশীদ ভুঁইয়ার ছোট ছেলে হামিম আল রশীদ। হামিম একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্প্রতি পড়াশোনা শেষ করেছেন।

ড. মো. শহীদুর রশীদ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য থাকার সময় চাকরি পেয়েছেন তার বড় ছেলে আসাদুল্লাহ হিল কাফি। যিনি বর্তমানে ডেপুটি চিফ ফার্ম সুপারিনটেন্ডেট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। শুধু তাই নয়, উপ-উপাচার্য থাকাকালে তার ভাগনি সাজিয়া আফরিনও চাকরি পেয়েছে। সাজিয়া আফরিন বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথলজি বিভাগের সেকশন অফিসার। নিজ পরিবার থেকে এভাবে একের পর এক চাকরি দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকেই। শুধু তাই নয়, উপাচার্যের পুত্রবধূ কম্পিউটার অপারেটর পদে আবেদন করেছেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে উপাচার্য পুত্রবধূর চাকরিও নিশ্চিত করতে পারে বলে আলোচনা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন মহলে।

বিশ্ববিদ্যালয়টির একাধিক সিনিয়র শিক্ষক ও কর্মকর্তারা জানান, উপাচার্য কর্মকর্তাদের পদোন্নতির সময় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর থাকলে সেটি পছন্দ করেন না অথচ তার (উপাচার্যের) ছেলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করেও চাকরি পেয়েছে। একাধিক কর্মকর্তা অভিযোগ করেছেন, উপাচার্যের বড় ছেলেকে বিভিন্ন সময়ে রিহ্যাব সেন্টারে নিয়ে রাখা হয়। ফলে মাসের পর মাস অফিসে অনুপস্থিত থাকলেও বেতন পেয়েছেন। বাবার ক্ষমতা দেখিয়ে বর্তমানে ঠিকমতো অফিস না করার প্রবণতা রয়েছে বড় ছেলের বিরুদ্ধে। এছাড়া শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে অসদাচরণের অভিযোগ রয়েছে।

শিক্ষক নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষা এক বছর আগে হয়ে সিন্ডিকেট মিটিং শেষ হয়েছে ভেরিফিকেশনের নামে। অথচ কর্মকর্তা নিয়োগের মৌখিক শেষ হওয়ার পরপরই গত ১৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সিন্ডিকেট মিটিং হয় এবং কোনো ভেরিফিকেশন ছাড়াই ১৯ ডিসেম্বর কর্মকর্তাদের যোগদান হয়। যোগদানের ক্ষেত্রে ন্যূনতম সময়ও দেওয়া হয়নি। মাত্র ১২ ঘণ্টার ব্যবধানে যোগদান করার সময় বেঁধে দেওয়া হয়।

পোষ্য কোটায় ভর্তি, চাকরি! :শিক্ষক নিয়োগে অ্যানিম্যাল নিউট্রিশন ও জেনেটিক ব্রিডিং বিভাগে মো. আব্দুর রায়হান রাতুল প্রভাষক পদে নিয়োগ পেয়েছেন। যার সিজিপিএ ৩.৬৩। তার প্রতিদ্বন্দ্বী তানজিনা আক্তারের সিজিপিএ ৩.৮৫ থাকলেও তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। রায়হান রাতুল বিশ্ববিদ্যালয়টির পোস্ট গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজ ডিন আব্দুর রাজ্জাকের সন্তান। আব্দুর রাজ্জাক উপাচার্যের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় কম সিজিপিএ নিয়ে চাকরি পেয়েছেন বলে একাধিক শিক্ষক জানিয়েছেন।

রাতুল ২০১৩ সালে পোষ্য কোটায় (২৫ নম্বর পাওয়ার শর্ত) শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানিম্যাল সায়েন্স অ্যান্ড ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদে ভর্তির সুযোগ পেয়েছিল। রাতুলের ছোট ভাইও একইভাবে পোষ্য কোটার আওতায় শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত।

আগের উপাচার্যরা একই কাজ করেছেন : কামাল উদ্দিন আহাম্মদ ২০১৬ সালের ১৪ আগস্ট শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ষষ্ঠ উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। ড. কামাল উদ্দিনের মেয়ে, ভাগনে এবং শ্যালকও শিক্ষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, উপাচার্য থাকাকালীন তার ভাগনে মো. মাহবুব আলমকে সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগ প্রদানের জন্যই তার জামাতাকে ভাইবা বোর্ডে বিশেষজ্ঞের পদে বসিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়টির অ্যাগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন ও ইনফরমেশন সিস্টেম ডিপার্টমেন্টের প্রাক্তন অধ্যাপক অধ্যাপক সাদাত উল্লাহ ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় বার শেকৃবির উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। প্রয়াত এই উপাচার্যের শ্যালক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও  শ্যালকের স্ত্রী ডেপুটি রেজিস্ট্রারের দায়িত্বে রয়েছেন। তার সময়েই এই দুই জন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পেয়েছিল। এছাড়া ঐ উপাচার্যের বড় ভাইয়ের মেয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি  পেয়েছেন। কর্মকর্তাদের অভিযোগ, উপাচার্যরা নিকটাত্মীয়দের চাকরি দিলেও বিষয়টি গোপন রাখেন। ফলে নিয়োগের দীর্ঘদিন পরেও জানতে পারেন না। এক্ষেত্রে যিনি তদবিরে চাকরি পেয়েছেন তিনিও পরিচয়ের ক্ষেত্রে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করে চলেন। 

বর্তমান উপাচার্য যা বললেন :উপাচার্য ড. শহীদুর রশীদ ভুঁইয়া বড় ছেলের চাকরির বিষয়ে বলেন, সে আমার নিজের সন্তান নয়, আমার স্ত্রীর আগের পরিবারের সন্তান। তবে এবার আমি আমার ছেলেকে চাকরি দিয়েছি। আর উপ-উপচার্য থাকার সময় ভাগনিকে চাকরি দিয়েছি। তবে সে স্নাতকোত্তর পাশ ছিল। সে কর্মকর্তা হবার যোগ্য হলেও তাকে কম্পিউটার অপারেটর পদে চাকরি দিয়েছি। আর পুত্রবধূ চাকরির জন্য আবেদন করেছেন কি না, আমি এখনো সেটা জানি না। আর আবেদন করলেই যে চাকরি হবে সেটা তো নিশ্চিত না।

উপাচার্য বলেন, আগের উপাচার্যদের সময় বিভিন্ন পদে নিয়োগে ৪ থেকে ৫ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। আর আমি টাকা ছাড়াই নিয়োগ দিয়েছি। আমি যাতে উপাচার্য না হতে পারি সেজন্য আমার বিরুদ্ধে উপাচার্য প্রার্থীরা অপপ্রচার করছেন।