মন্ত্রিসভায় খসড়া উঠছে সোমবার
নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ : আগামীতে কোনও সিটি নির্বাচনেই দলীয় প্রতীক থাকছে না। সিটি করপোরেশন আইনে রাজনৈতিক দল-সংক্রান্ত সংজ্ঞা উঠিয়ে দিয়ে দলীয় মনোনয়নের সুযোগ বন্ধ করা হচ্ছে। এর পরিবর্তে ২০১৫ সালের আগে যেভাবে সিটি নির্বাচন হতো, আগামীতেও একইভাবে দলীয় প্রতীকবিহীন নির্বাচন হবে। এজন্য সিটি করপোরেশন আইনে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এরই মধ্যে আইনের বেশ কয়েকটি ধারা সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। সোমবার ‘সিটি করপোরেশন (সংশোধন) আইন, ২০২৪’-এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইনের (৪৮ ক) দফায় ‘রাজনৈতিক দল’ সংক্রান্ত সংজ্ঞা বাতিলের প্রস্তাব রেখে মন্ত্রিসভায় পাঠিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। প্রস্তাবে আইনের ৫৫-ক, ৫৫-খ ও ৫৫-ঘ দফা নতুন সন্নিবেশ করা হয়েছে। ৫৫-ক দফায় বলা হয়েছে, “‘স্বতন্ত্র প্রার্থী’ অর্থ এইরূপ কোনও প্রার্থী যিনি রাজনৈতিক দল কর্তৃক মনোনয়নপ্রাপ্ত নহেন’’– এমন বিধান আইনে যুক্ত করা হয়েছে। এ ধারা পাস হলে সিটি নির্বাচনে কোনও রাজনৈতিক দলের প্রতীক ব্যবহার করতে পারবেন না প্রার্থীরা।
২০১৫ সালে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আইন প্রণয়নের পর থেকে স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার হচ্ছে। এ সময়ের পরের নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগ নৌকা প্রতীকে এবং বিএনপি ধানের শীষ প্রতীকে প্রার্থী দেয়। তবে সামনের উপজেলা, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা ভোটে দলীয় প্রতীক না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
আগামী ৯ মার্চ ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে নির্বাচন ও কুমিল্লা সিটিতে উপ-নির্বাচন হবে। একই দিন কয়েকটি পৌরসভায়ও ভোট হবে। গত বুধবার এই দুটি সিটি করপোরেশন ছাড়াও ৯টি পৌরসভা, কয়েকটি ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড মিলে ২৩৩টি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
অনেকে বলছেন, দলীয় কোন্দল কমানো ও নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে সিটি নির্বাচনে দলীয় প্রতীক তুলে দেওয়া হচ্ছে। সরকার মনে করছে, তাতে বিএনপিসহ যেসব দল সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছে, তাঁদের অনেকেরই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে। শুধু তাই নয়, দলনিরপেক্ষ স্থানীয় গণমান্য ব্যক্তিদেরও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার আগ্রহ তৈরি হবে। বেশি সংখ্যক প্রার্থী অংশ নিলে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে, ভোটার উপস্থিতি বাড়বে। ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরিতে সুবিধা হবে। অবশ্য এতে সহিংসতা ও নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘনের প্রবণতা বাড়ার আশঙ্কাও করেছেন কেউ কেউ।
সম্প্রতি দলীয় ফোরামে আলোচনা করে যেসব সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদে ভোট হতে যাচ্ছে, সেখানে দলীয় প্রতীক নৌকা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। তবে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের বিষয়ে দলটি স্পষ্ট করে কিছু জানায় নি।
জানা গেছে, সিটি করপোরেশন নির্বাচন হবে মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগের তিন মাসের (৯০ দিন) মধ্যে– এমন বিধান রেখে স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) (সংশোধন) আইনের খসড়ায় গত ৯ অক্টোবর নীতিগত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। তবে চূড়ান্ত অনুমোদন হয়নি। বর্তমান আইন অনুযায়ী, সিটি করপোরেশনের মেয়াদ ধরা হয় প্রথম সভা থেকে পরবর্তী পাঁচ বছর। আর কোনো সিটি করপোরেশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ছয় মাসের (১৮০ দিন) মধ্যে ভোট গ্রহণ করতে হয়।
এবার সংশোধিত খসড়া মন্ত্রিসভার চূড়ান্ত অনুমোদন পেলে বেশ কিছু পরিবর্তন আসবে সিটি করপোরেশন আইনে। আইনটি সংসদে পাস হলে সিটি করপোরেশন এলাকায় এখন থেকে বৃষ্টিজনিত পানির ড্রেনেজ ব্যবস্থার কাজটি করবে সিটি করপোরেশন। এখন চুক্তির মাধ্যমে কাজটি হয়।
প্রণীত খসড়ায় সিটি করপোরেশনের ‘সচিব’ পদের নাম পরিবর্তন করে ‘নির্বাহী কর্মকর্তা’ করা হয়েছে। পদটি সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার নিচের পদ হবে। সংশোধিত নতুন আইনে মেয়র ও কাউন্সিলরদের সারা বছরের ছুটি কমানো হয়েছে। মেয়র ও কাউন্সিলরদের ছুটি হবে বছরে এক মাস। এতদিন তারা তিন মাস পর্যন্ত ছুটি পেতেন। এ ছাড়া আগে কোনো কাউন্সিলরের পদ ছুটিজনিত বা কোনো কারণে শূন্য হলে পার্শ্ববর্তী ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের দায়িত্ব দেওয়া হতো। প্রস্তাবিত খসড়া অনুযায়ী, পদ শূন্য হলে সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর ওই দায়িত্ব পালন করবেন। সিটি করপোরেশনভুক্ত কোনো ব্যক্তি মালিকানা বা প্রাতিষ্ঠানিক মালিকানার রাস্তা যথাযথভাবে সংস্কার বা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা না হলে জরিমানা করার ব্যবস্থা থাকবে।
খসড়ায় বলা হয়েছে, এই আইনের শিরোনাম ‘স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০২৪’ নামে অভিহিত হবে। ২০০৯ সালের ৬০ নম্বর আইনের ধারা ২-এর সংশোধন হবে। স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০১৫ (২০০৯ সালের ৬০ নম্বর আইন)-এর ২ ধারার (ক) দফা (৪৮)-এর সন্নিবেশ করে আইনের ধারা সংশোধন করা হচ্ছে। এতে (৪৮ক) ‘রাজনৈতিক দল’ অর্থ রিপ্রেজেন্টেশন অব দ্য পিপলস অর্ডার-১৯৭২ আর্টিকেল-২ সংজ্ঞায়িত করে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল নামে যুক্ত করা হয়। (খ) দফা ঘ(৫৫)-এর পর (৫৫ক) সন্নিবেশ করা হয়। ৫৫ক-এ বলা হয়, “‘স্বতন্ত্র প্রার্থী’ অর্থ এইরূপ কোন প্রার্থী যিনি রাজনৈতিক দল কর্তৃক মনোনয়নপ্রাপ্ত নহেন।” ৬০ নম্বর আইনের নতুন ধারা ৩২ক-এ ছিল– “নির্বাচনে অংশগ্রহণ– ধারা ৯-এর বিধান সাপেক্ষে, কোন সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য ব্যক্তিকে রাজনৈতিক দল থেকে মনোনীত বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হইতে হবে।” ধারা ৩৫-এর উপধারা (২)-এর পূর্বে উল্লিখিত বিদ্যমান বিধানটি উপধারা (১) সংজ্ঞায়িত করে ২০১৫ সালে ২৬ নভেম্বর গেজেট প্রকাশ করা হয়।
এবার সংশোধিত আইনে ওপরের এসব ধারা বাতিল করে (খ) দফা ঘ(৫৫)-এর পর (৫৫ক) সন্নিবেশিত করা হয়েছে।
এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসর) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আসলে নির্বাচন কাঠামো ভেঙে পড়েছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতীক না থাকা ভালো সিদ্ধান্ত এবং আরও আগে এ আইন বাতিল করা দরকার ছিল।’ তিনি আরও বলেন, ‘সরকার যে সিদ্ধান্ত নিতে চাচ্ছে, তাই-ই ঘটছে। পার্লামেন্টে তো আর বিরোধিতা করার কোনো কার্যকর দল নেই। আওয়ামী লীগ তার প্রয়োজনেই সব করছে। জনভাবনা বা জনদায় তো আর গুরুত্ব পায় না। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতীক থাকা না-থাকার বিষয়টিও ঠিক তাই।’
২০১৫ সালের পর থেকে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন শুরুর পর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের বিপাকে পড়তে হয়েছে। একজনকে প্রতীক দিলে আরেকজন বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছেন। তাতে দলীয় শৃঙ্খলা যেমন নষ্ট হয়েছে, তেমনই তৃণমূলে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছে। কোথাও কোথাও তা সংঘাতের দিকে গেছে।