ফসলের মাঠ ফাঁকা, ভোটের প্রচারে ভাড়া করা শ্রমিক

ফসলের মাঠ ফাঁকা, ভোটের প্রচারে ভাড়া করা শ্রমিক

নিজস্ব সংবাদদাতা, বাঙলার কাগজ; রংপুর : ‘পানির বুলি (জন্য) ভুট্টার গাছগুলা খাঁ খাঁ করতোচে বাহে, কয়দিন থাকি কামলা (কৃষি শ্রমিক) পাওয়া যাইতোচে না। সবায় ভোটোত গেইচে। এবার বুঝি ফসল হবার নয়।’ ভুট্টা ক্ষেত বাঁচাতে স্ত্রীকে নিয়ে পাইপ দিয়ে পানি সেচ দেওয়ার প্রাক্কালে এমন কথা বলেন গঙ্গাচড়ার মহিপুর এলাকার কৃষক হারুন অর রশিদ। শুধু তিনিই নন, বিভিন্ন প্রার্থী নির্বাচনী প্রচারণায় টাকা দিয়ে শ্রমিক নেওয়ায় ফসলের মাঠে কাজের মানুষ পাচ্ছেন না কৃষকরা। বিশেষ করে কৃষি শ্রমিক বেশি আয়ের আশায় ভোটের মাঠে থাকায় বেকায়দায় পড়েছেন তিস্তার চরের কৃষকরা।

গত শুক্রবার (২২ ডিসেম্বর) সকালে রংপুরের গঙ্গাচড়ার তিস্তার চর মহিপুর ও ছালাপাক এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ফসলে ভরে গেছে মাঠ। আলু, তামাক, ভুট্টা , রসুন, পেঁয়াজ, মিষ্টিকুমড়াসহ নানা ধরনের শাকসবজির চারা বেড়ে উঠছে লকলক করে।  ধু-ধু বালুচরে যেন সবুজগালিচা। কিন্তু সব মিলিয়ে চিত্রটা অন্যবারের মতো নয়। নির্বাচন সামনে রেখে চরগুলোর চেহারা যেন পাল্টে যাচ্ছে। এ মৌসুমে কুয়াশায় ঢাকা ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাজারো শ্রমিক তিস্তার চরে ফসলের ক্ষেত পরিচর্যায় ব্যস্ত থাকলেও এবারে সেই চিত্র নেই। দু-একজনের দেখা মিললেও তারা জমির মালিক। শ্রমিক না পেয়ে ফসল বাঁচাতে নিজেরাই মাঠে নেমেছেন।

মহিপুর চরে ৭৫ শতক জমি লিজ নিয়েছেন হারুন অর রশিদ। আমন ধান কাটার পর সেখানে ১০ দিন আগে ভুট্টা লাগিয়েছেন। বালুচরের ভুট্টা ক্ষেতে তিন দিন অন্তর সেচ দিতে হয় উল্লেখ করে তিনি জানান, এলাকায় নারী-পুরুষ কোনো শ্রমিক মিলছে না। সবাই ভোটের প্রচারণায় যুক্ত হয়েছেন। পানির অভাবে লাল হয়ে যাওয়া ভুট্টার গাছ বাঁচাতে স্ত্রীসহ নিজেই সেচ দিচ্ছিলেন। ইছলী এলাকার বাসিন্দা দুই ভাই মোমিনুর ও এজাজুল মহিপুর চরে তামাক ক্ষেত নিড়ানি দিচ্ছিলেন। তারা জানান, প্রতি বছরের মতো প্রায় চার বিঘা লিজ নেওয়া জমিতে তামাকসহ ভুট্টা, মিষ্টিকুমড়া ও শাকসবজি চাষ করেছেন। কয়েকদিন থেকে এলাকায় কৃষি শ্রমিক মিলছে না উল্লেখ করে তারা জানান, চরের কৃষি কাজে একজন শ্রমিককে প্রতিদিন ৫০০ টাকা হাজিরা ও দুই বেলা খাবার দিতে হয়। নারী শ্রমিক মজুরি পান ৩০০ টাকা। কিন্তু ভোটের সময় চরের আবাদ ব্যাহত হবে।

ছালাপাক চরের কৃষক আব্দুর রাজ্জাক ও আবুল কাশেম জানান, তিস্তার চরে এখন আলু, বেগুন, টমেটো, মরিচ,  পেঁয়াজ, মিষ্টি কুমড়াসহ সব ধরনের শাকসবজির চাষ হয়। এ কারণেই এখানকার কৃষকরা ভালো আছে। কৃষি শ্রমিকদেরও কাজ মিলছে। আগে আমন ধান কাটার পর কৃষি শ্রমিকদের হাতে কাজ থাকত না। কিন্তু চরাঞ্চলে রবি ফসল চাষের ভরা মৌসুমে ভোটের মৌসুম শুরু হওয়ায় কৃষি শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। এর নেতিবাচক প্রভার পড়ছে আবাদে।

একরামুল হক বলেন, ‘হামরা তো জীবনভর মাঠোত কাম করি, দিন হাজিরা পাই ৫০০ টাকা। ভোটের কামোত পাই ১ হাজার টাকা, পরিশ্রমও কম।’ তার পাশে ছিলেন আনছার আলী, ইছলী এলাকার রহমত আলী ও আব্দুল করিম। অন্য এক শ্রমিক বলেন, ‘ভোট তো আর সব সময় আইসে না। প্রার্থীর আশপাশে থাকলেই টাকা পাওয়া যায়। ভোট শ্যাষ হইলে ফির মাঠোত কাম করমো।’ এ ব্যাপারে দু’জন প্রার্থীর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, নির্বাচন মানেই জনসমাগম। পোস্টার সাঁটানো, মাইকিং, পথসভা, শোডাউন, গণসংযোগসহ নানা কাজে মানুষের প্রয়োজন হয়। আর সে জন্য তাদের পারিশ্রমিক দেওয়া হয়।

জাতীয় নির্বাচনে গত ১৮ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দের পর সর্বত্র নির্বাচনী প্রচারণ জমে উঠছে। রংপুর-১ (গঙ্গাচড়া) আসনে জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীসহ ৯ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। শোডাউন করতে প্রার্থীরা টাকার বিনিময়ে কৃষি শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ ভাড়া করছেন। কম শ্রমে বেশি টাকা পাওয়ার আশায় চরাঞ্চলের কৃষি শ্রমিকরা ফসলের মাঠ ছেড়ে নির্বাচনী প্রচারণায় যোগ দিয়েছেন।

কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, রংপুর জেলায় এ পর্যন্ত শীতকালীন শাকসবজির আবাদ হয়েছে প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে। এর সিংহভাগই আবাদ হয়েছে গঙ্গাচড়া ও কাউনিয়া উপজেলার তিস্তার চরাঞ্চলে।