পাহাড়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণে চার ‘ওস্তাদ’!

পাহাড়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণে চার ‘ওস্তাদ’!

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ : পাহাড়ে জঙ্গি আস্তানায় ধারাবাহিক অভিযানের পর এখনও ঘরছাড়া ৪১ তরুণের খোঁজ মিলছে না। এরই মধ্যে গ্রেপ্তার জঙ্গিদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বান্দরবানের রুমায় কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) ও নতুন জঙ্গিগোষ্ঠী জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়ার গোপন আস্তানায় অভিযান চালায় র‌্যাব। পাহাড়ের বিভিন্ন গোপন আস্তানায় বম সম্প্রদায়ের চার সদস্য জঙ্গিদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন।

কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র আমিনুল ইসলাম ওরফে আল আমিনের বাবা নুরুল ইসলাম ১৭ জানুয়ারি বান্দরবান চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হত্যা মামলার আবেদন করেন। সেখানে তিনি বম সম্প্রদায়ের ওই প্রশিক্ষকদের দায়ী করেছেন। আবেদনটি আমলে নিয়ে পুলিশকে তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। তাঁরা হলেন-

লালমোহন রিয়াল ওরফে কর্নেল সলোমান, ভাঙচুর লিয়ান, লালমুন সাং বম ওরফে পাদন ও দিদার ওরফে চম্পাই। আবেদনে বম সম্প্রদায়ের নাথানা লনচে ওরফে নাথানকেও দায়ী করা হয়। তাঁদের সহায়তা করেন সাংরেম বম ক্যাপ্টেন ও সাংপা।

গোয়েন্দারা বলছেন, তাঁদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। জঙ্গিরা প্রশিক্ষকদের 'ওস্তাদ' বা 'ওস্তাদজি' বলে সম্বোধন করতেন। র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার পাঁচ তরুণও প্রশিক্ষকদের বিষয়ে নানা তথ্য দিয়েছেন। আদালত আমিনুলের বাবার ওই অভিযোগ আমলে নিয়ে পুলিশকে তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন।
নিখোঁজ তরুণদের পরিবারের সদস্য ও একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। 

এ ছাড়া র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার পাঁচ জঙ্গি ১৭ জানুয়ারি আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। কারা, কীভাবে তাঁদের সহায়তা করেছিল- এসব তথ্য সেখানে উঠে আসে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বাঙলার কাগজ ও ডনকে বলেন, জঙ্গি প্রশিক্ষণে কেএনএফের কৌশল সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। একটি বাহিনীর আদলে তারা প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালিয়েছে।

কুমিল্লা থেকে কয়েক দফায় নিখোঁজ ১৫ তরুণসহ সারাদেশ থেকে ঘরছাড়াদের মগজ ধোলাই ও সহায়তাকারী হিসেবে আরও ১৫ জনের নাম পাওয়া গেছে। তাঁরা হলেন- কুমিল্লা সদর দক্ষিণের প্রতাপপুরের মোখলেছুর রহমানের ছেলে আনিছুর রহমান মাহমুদ, শামিন মাহফুজ ওরফে স্যার, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁর আনোয়ার হোসেনের ছেলে মোশাররফ হোসেন বাবু, সিলেটের দক্ষিণ সুরমার মাওলানা হোসাইনের ছেলে আবদুল্লাহ মায়মুন ওরফে মুমিন ওরফে শায়েখ সিলেট, সিলেট সদরের ইসলামপুরের আবদুস সাত্তারের ছেলে মাসকুর রহমান রণবীর ওরফে মাসুদ, সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরের সৈয়দ আবুল কালামের ছেলে সৈয়দ মারুফ আহমেদ, আবদুল কাদের ওরফে সুজন, কুমিল্লার শাহ মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ, সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শিবির আহমেদ, ইসমাইল হোসেন হানজালা, কুমিল্লা সদর দক্ষিণের সালেহ আহম্মদ, সিলেটের ওসমানী নগরের সালেহ আহমেদ, সাদিকুর রহমান সুমন, ইমরান বিন রহমান শিথিল, বায়োজিদ ইসলাম ও নিজাম উদ্দিন হিরণ। এ ছাড়া পাহাড়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণের সব আয়োজন দেখভাল করেছেন নাথানা লনচে ওরফে নাথান বম।

র‌্যাবের কর্মকর্তারা জানান, কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ তরুণ আমিনুলের লাশের সন্ধানে সোমবার লুয়াংমুয়ালপাড়া এলাকায় প্রায় পাঁচ ঘণ্টা অভিযান চালানো হয়। ওই এলাকাটি থানচি থেকে ২৯ কিলোমিটার ও রুমা থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে। অভিযানের সময় তামলাওপাড়ার বমরা জানিয়েছেন, কেএনএফ জঙ্গিগোষ্ঠীর অত্যাচারে ও নানামুখী চাপে পাড়াবাসী টিকতে না পেরে কোথাও চলে গেছেন। একইভাবে পাশের পাইনুয়ামপাড়ায়ও কেউ নেই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক র‌্যাবের এক কর্মকর্তা জানান, অভিযানের সময় দু'জন জঙ্গি তাঁদের সঙ্গে ছিলেন। তাঁদের একজন আবু সালেহ ওরফে সাইহা গোয়েন্দাদের জানান, কেএনএফের সঙ্গে দুই বছর ধরে বিভিন্ন গোপন আস্তানায় ছিলেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে কেএনএফের আস্তানা ও প্রশিক্ষণ ছাউনির কিছু ধ্বংস হয়েছে। আবার কিছু আস্তানা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। জঙ্গি আস্তানার আশপাশে পাথরের গায়ে কেএনএফ নামটি খোদাই করা ছিলো।

ওই র‌্যাব কর্মকর্তা জানান, পাহাড়ে জঙ্গি আস্তানায় গিয়ে কুমিল্লার ছাত্র আমিনুল ছাড়া আরও একজন মারা গেছেন। তিনি হলেন নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীর জোহায়ের বিন রহমান। জঙ্গিরা তাঁর নতুন নাম দিয়েছিলেন ডা. আহমেদ। গ্রেপ্তার জঙ্গিরা গোয়েন্দাদের জানান, আস্তানায় তাঁদের মূল প্রশিক্ষক ছিলেন বম সম্প্রদায়ের ওই চার ব্যক্তি। অস্ত্র চালানোসহ শারীরিক নানা কসরত তাঁদের শেখাতেন লালমোহন রিয়াল ওরফে কর্নেল সলোমান, ভাঙচুর লিয়ান, লালমুল সাং বম ওরফে পাদন ও দিদার ওরফে চম্পাই।

চুক্তি অনুযায়ী উগ্রপন্থি সংগঠনের সদস্যরা অর্থ দেবে কেএনএফকে। এর বিনিময়ে আস্তানায় যাওয়া তরুণদের খাবার ও প্রশিক্ষণ দেবে কেএনএফ। তবে পাহাড়ে অভিযান শুরুর পর সঠিকভাবে খাবার সরবরাহ করতে পারছিল না কেএনএফ। আবার জঙ্গিরা তাঁদের ঠিকঠাক অর্থ দিতে ব্যর্থ হয়। এতে কয়েকজন জঙ্গি ক্ষুধায় অসুস্থ হয়ে পড়েন।

জঙ্গিদের কেউ কেউ গোয়েন্দাদের জানান, বান্দরবানের রুমার গহিন অরণ্যে না খেয়ে, রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন কুমিল্লার তরুণ আমিনুল। তবে তাঁর বাবার দাবি, ভুল বুঝতে পেরে সঠিক পথে ফেরার চেষ্টা করলে জঙ্গিরা তাঁর ছেলেকে খুন করেছে। এর পর লাশ গুম করতে লুয়াংমুয়ালপাড়ায় পুঁতে রাখা হয়। ছলে-বলে-কৌশলে কোমলমতি তরুণদের প্রলুব্ধ করে জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে একটি চক্র। এই চক্রে কুমিল্লার কুবা মসজিদের ইমাম হাবিবুল্লাহ হাবিবসহ আরও অনেকে রয়েছেন। তাঁরা তরুণদের মগজ ধোলাই করেছেন। তাঁদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান আমিনুলের বাবা।

র‌্যাব জানায়, এখন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ৫৫ তরুণ কেএনএফের ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিতে যান। বিভিন্ন অভিযানে ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দু'জন পাহাড়ে মারা গেছেন। বাকি ৪১ জনের খোঁজ নেই। নিখোঁজ তরুণরা ছাড়াও জঙ্গিদের অর্থদাতা, প্রশিক্ষক ও শূরা সদস্যদের গ্রেপ্তারে জঙ্গিবিরোধী অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

র‌্যাবের এক কর্মকর্তা জানান, বম জঙ্গিরা খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী। তবে জঙ্গিরা তাঁদের আস্তানায় গিয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়ার আগে নিজেদের মতো করে ইসলামের একটি ব্যাখ্যা হাজির করেন।