প্রদিতি রাউত প্রমা : ত্রিশালে নজরুলকে নিয়ে যত কিংবদন্তি

প্রদিতি রাউত প্রমা : ত্রিশালে নজরুলকে নিয়ে যত কিংবদন্তি

উপ-সম্পাদকীয় মত, বাঙলার কাগজ : নজরুল ১৯১৪ সালের জুন মাসে ত্রিশালে আসেন। এখানে তিনি ছিলেন ১৯১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। কবিকে ত্রিশালে কাজীর শিমলা গ্রামে নিজ বাড়িতে নিয়ে আসেন দারোগা রফিজ উল্লাহ। নজরুল পূর্ববঙ্গের মানুষ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে প্রথম পরিচিত হন ত্রিশালযাপনের মধ্য দিয়ে। এখানকার দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন তিনি।

অষ্টম শ্রেণিতে উঠে ত্রিশাল ছাড়েন। চিরদিনের জন্য নজরুল ত্রিশাল ছাড়লেও নজরুলকে আজও ছাড়ে নি ত্রিশাল। তাঁকে নিয়ে ত্রিশালে প্রচলিত রয়েছে নানা কিংবদন্তি।

এসব কিংবদন্তি লোকমুখে প্রচলিত কোনো সত্য ঘটনার দূরাগত ছায়ায় রচিত—দিন–তারিখ বা সঠিক বৃত্তান্ত নেই। কিংবদন্তিগুলো ক্ষেত্রসমীক্ষার মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়েছে। আমি যখন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগে পড়তাম, তখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব নজরুল স্টাডিজে আমার শিক্ষক মেহেদী উল্লাহর অধীনে একটি গবেষণা করি। ‘ত্রিশালে নজরুলের শৈশবের বিনির্মাণ: কিংবদন্তির আলোকে’ শিরোনামের এ গবেষণাকর্মের জন্যই তখন নজরুল–সংক্রান্ত এই কিংবদন্তিগুলো মাঠপর্যায় থেকে সংগ্রহ করা হয়।

কিংবদন্তিগুলোর সত্যাসত্য নিরূপণ করা যদিও এখন বেশ দুঃসাধ্য, তবুও কিংবদন্তিগুলো ত্রিশালবাসীর মুখে মুখে এখনো জীবন্ত হয়ে আছে।

রুটির দোকান থেকে বেরিয়ে দুখু মিয়া এলেন ত্রিশালে :
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলে রুটির দোকানে কাজ করতেন কিশোর নজরুল। একদিন তিনি মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গেছেন। মালিককে বলে গেছেন, এক দিন থেকেই ফিরবেন। কিন্তু এক দিনের জায়গায় তিন দিন কাটল। ফিরলে মালিক তাঁকে বললেন, ‘কীরে দুখু মিয়া, তুই এক দিনের কথা বলে তিন দিন থেকে আসলি, আমার তো দোকানটা চালাতে হয়। ভালোভাবে কাজ করলে কর, নইলে বিদায় হ।’ 

তখন রাত নয়টা বাজে। তখনই নজরুল দোকান ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। সেই রাতে বাড়িতে ফেরা সম্ভব না হওয়ায় নজরুল রফিজ উল্লাহ নামের এক দারোগার বাড়ির বারান্দায় আশ্রয় নেন। এই দারোগার বাড়ি ছিল ত্রিশালে।

শেষ রাতে রফিজ উল্লাহ যখন প্রাকৃতিক কাজ সারতে  উঠলেন, তখন দেখলেন বারান্দায় একটা ছেলে। এ সময় নজরুল তাঁকে নিজের পরিচয় ও দুরবস্থার কথা জানান। পরে দারোগা তাঁকে ত্রিশালে নিয়ে আসেন।

ভর্তি হলেন দরিরামপুরে স্কুলে :
রফিজ উল্লাহ দারোগার কর্মস্থল আসানসোল হওয়ায় তিনি নজরুলকে ত্রিশালের কাজীর শিমলায় নিজের বাড়িতে রেখে চলে যান কর্মস্থলে; এবং তাঁকে বলে যান বাড়ির কাজকর্ম করতে। তাঁর মায়ের দেখাশোনা করতে। পরে তিনি যখন বাড়িতে আসেন, তখন দারোগার মা তাঁকে বলেন, ‘তুমি যে ছেলে নিয়ে এসেছ, সে তো কাজের ছেলে নয়, সে তো বই নিয়ে আগ্রহী বেশি।’

এ সময় দারোগা সাহেব পড়ালেখায় নজরুলের আগ্রহ দেখে তাঁকে স্কুলে ভর্তি করে দেন। কিন্তু কাজীর শিমলা গ্রামের আশপাশে তখন কোনো স্কুল ছিল না। ফলে সবচেয়ে কাছের দরিরামপুর স্কুলে কবিকে ভর্তি করা হয়। সেটাও ছিল দারোগা বাড়ি থেকে ১০-১১ কিলোমিটার দূরে। অর্থাৎ ত্রিশালেই।

স্কুল থেকে পালিয়ে :
ত্রিশালে যে বাড়িতে নজরুল থাকতেন, তার পাশের বাড়িতে কবির এক বন্ধু ছিল, তাঁরা দুজন একসঙ্গে পড়াশোনা করতেন। একই স্কুলে পড়তেন। কিন্তু স্কুল থেকে কাজীর শিমলা অনেক দূরে ছিল। তাই তাঁরা প্রায়ই স্কুল ফাঁকি দিতেন। রাস্তায় খেলাধুলা করে চলে যেতেন বাড়িতে; এবং বাড়িতে গিয়ে বলতেন, শরীর খুব ক্লান্ত, আজ আর পড়বো না।

পরে সন্ধ্যা থেকে শুরু হতো তাঁদের গানবাজনার আসর। এ কথা একদিন দারোগা রফিজ উল্লাহ জানতে পারেন। জেনে নজরুলকে তিনি অনেক শাসন করেন, মারধর পর্যন্ত করেন। বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। নজরুল এতে ভীষণ কষ্ট পান। এভাবেই তিনি ত্রিশালের কাজীর শিমলা ছাড়েন।

পরে ত্রিশালে আরও দু–এক বাড়িতে তিনি জায়গির ছিলেন বলে জানা যায়। এর মধ্যে বিচুতিয়া ব্যাপারীর বাড়িতে তিনি জায়গির ছিলেন—এমন জনশ্রুতি ত্রিশালে প্রচলিত আছে।  

দে গরুর দড়ি ছেড়ে... :
ত্রিশালে থাকার সময় নজরুল যাত্রাপালা দেখতে পছন্দ করতেন। তাই সন্ধ্যায় লুকিয়ে চলে যেতেন দূরের গ্রামে যাত্রা দেখতে। তারপর ফিরতেন রাত তিনটা-চারটার দিকে। একদিন বাড়ির উঠানে পা রাখার পর তিনি জোরে চিত্কার করে ওঠেন, ‘চোর চোর...’। বলতে থাকেন, ‘চোর গরু নিয়ে যাচ্ছে।’ তাঁর এমন কথা শুনে ঘুম ভেঙে গেল শুনেই বাড়ির লোকজনের। বেরিয়ে এলেন তাঁরা। কোনোরকমে গরুগুলোকে ধরলেন বটে, কিন্তু ততক্ষণে চোর পালিয়েছে। এ ঘটনায় ঘরের কর্তা দুখুর ওপর খুশি হয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বললেন, ‘ক্ষুধা লাগে না তোর! যা ভাত খা গিয়ে।’ নজরুল এতক্ষণ কোথায় ছিলেন, তা আর জানতে চাইলেন না। এই যাত্রায় বাঁচা গেল!

তবে আসল ঘটনা হলো, এত রাতে ক্ষুধা লাগায় নিজেই গরু ছেড়ে দিয়েছিলেন নজরুল। এতে করে রাতে ঘরেও ঢোকা হলো আবার পেটে ভাতও জুটল।

সুতিয়া নদীর তীরে... :
দরিরামপুর হাইস্কুলের পাশেই সুতিয়া নদী। শুকনি বিলের পশ্চিম পাশে একটা বটগাছ আছে। যেদিন স্কুলে নজরুলকে বকাঝকা করা হতো বা কোনো বন্ধু তাঁর সঙ্গে খারাপ আচরণ করত, সেদিন তিনি এই বটগাছের নিচে বসে থেকে সারা দিন কাটিয়ে দিতেন বলে জানা যায়। বটগাছের নিচে অনেক কৃষক, পথিক এসে তাঁর গল্প শুনতেন—এমন কথাও প্রচলিত আছে।

কবির লড়াই :
ত্রিশালের পাঁচপাড়ায় অনেকগুলো যাত্রার দল, ঘাটুর দল তৈরি হয়েছিল। নজরুল গানবাজনা ভালোবাসতেন। তাই বন্ধুবান্ধব নিয়ে ওখানে বসে থাকতেন। মাঝেমধ্যে মঞ্চে উঠে নিজেও নাটক করতেন বলে জনশ্রুতি আছে। সে সময় কবির লড়াইও হতো। এতে যিনি জিততেন, তাঁকে পুরস্কার দেওয়া হতো। মাঠপর্যায়ে লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নজরুল অনেকবার এ পুরস্কার পেয়েছিলেন।

বাঁদরে খেল কলা :
একদিন বিচুতিয়া ব্যাপারীর ছেলের বউ গাছ থেকে পাকা কলা নিয়ে আসতে বলেছিলেন নজরুলকে। তো তিনি সব পাকা কলা খেয়ে ফেলে কাঁচা কলার কাঁদি নিয়ে এসে বললেন, কলা সব বাঁদরে খেয়ে নিয়েছে। আসল ঘটনা হলো- কাঁঠাল, আম, দুধ, কলা দিয়ে ভাত খাওয়া নজরুলের সবচেয়ে পছন্দের ছিলো। তাই তিনি এমন কাণ্ড করেছিলেন।

বটের মূলে আড়বাঁশি :
ভরদুপুরে যখন এখানে কেউ থাকত না, তখনো নজরুল এখানে থাকতেন। বাঁশি বাজাতেন, গান গাইতেন। মাঝেমধ্যে আশপাশের কৃষকেরা তাঁর কাছে এসে বসে তাঁর গান শুনতেন। নজরুলকে দেখে পরে আরও অনেক রাখাল এখানে বসে বাঁশি বাজাত। একদিন এক রাখালের কাছে নজরুল বাঁশি চান, কিন্তু রাখাল দেন না। তাতে নাকি দুজনের মধ্যে খুব ঝগড়া হয়েছিলো।

ভাঙা হারমোনিয়াম... :
বিচুতিয়া ব্যাপারীর বাড়িতে একটি ভাঙা হারমোনিয়াম ছিল। নজরুল প্রতিদিন বলতেন হারমোনিয়ামটা ঠিক করে দিতে। শেষে নিজেই তাঁর তিন বন্ধু নিয়ে হারমোনিয়াম ঠিক করতে বসে যান। হারমোনিয়াম ঠিক করার পর ব্যাপারীর বাড়ির পুকুরঘাটে প্রতিদিন নাকি তিনি গান শোনাতেন। তখন ব্যাপারীর উঠান ভরে যেত লোকলস্করে।

ফারসিতে পেয়েছিলেন ৯৮ :
তখন ত্রিশালের অধিকাংশ ছেলেমেয়েই মাদ্রাসায় পড়ত। স্কুলে তেমন কেউ পড়ত না। এ জন্য গ্রামের লোকজন নজরুল ইসলামকে আলাদা চোখে দেখত। তাঁর যখন জায়গির পেতে সমস্যা হচ্ছিল, সেই সময় স্কুলেরই এক শিক্ষক তাঁকে বিচুতিয়া ব্যাপারীর বাড়িতে নিয়ে যান। তত দিনে ক্লাসে প্রথম হয়ে অষ্টম শ্রেণিতে উঠেছেন কবি। ফারসিতে তিনি পেয়েছিলেন ৯৮।

তবে বেশিরভাগ ছেলেই ফারসিতে ফেল করেছিল। অগত্যা তাদের পাস করাতে ফারসিতে আরও ৫ নম্বর গ্রেস হিসেবে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এদিকে ৫ নম্বর গ্রেস দেওয়া হচ্ছে শুনে নজরুল মৌলভি জহুরুল হক সাহেবের কাছে গিয়ে তাঁকেও ওই ৫ নম্বর বাড়িয়ে দিতে বলেন।

কিন্তু স্কুলের প্রধান শিক্ষক নজরুলকে ওই নম্বর দিতে অপারগতার কথা জানালে তিনি বলেন, যে স্কুলে ন্যায়বিচার নেই, সেখানে নজরুল ইসলাম পড়বে না। হয়তো আপনারা স্কুল সার্টিফিকেট দেবেন না। তাতে আমার কিছু আসে যায় না।

এ সময় প্রধান শিক্ষক ইংরেজিতে কথা বলে নজরুলকে ভড়কে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নজরুল ভয় পাওয়ার বা ভড়কে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না। তিনি অত্যন্ত ধীর-গম্ভীরভাবে ইংরেজিতেই প্রধান শিক্ষকের সব কথার উত্তর দিয়েছিলেন।

প্রধান শিক্ষক ও নজরুলের মধ্যে কথা–কাটাকাটির সময় যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, ইংরেজিতে নজরুলের উত্তর শুনে তাঁরাও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। অষ্টম শ্রেণিপড়ুয়া ছেলের পক্ষে প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে মিনিট পনেরো ইংরেজিতে কথা বলা সোজা ব্যাপার নয়।

এ ঘটনায় ওই প্রধান শিক্ষক নজরুলের ওপর রেগে যান বলে জানা যায়। এরপরই স্কুল থেকে এক কাপড়ে ত্রিশাল ছাড়েন নজরুল। 

যদিও এই কিংবদন্তির সত্যাসত্য নিয়ে অনেকেই সন্দেহ পোষণ করেছেন।