নয়া দল বিডিপির সবাই জামায়াত-শিবিরের!

নয়া দল বিডিপির সবাই জামায়াত-শিবিরের!

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ ও ডন : আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নানামুখী পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। বুধবার (২৬ অক্টোবর) নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিবন্ধনের জন্য বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি (বিডিপি) নামে নতুন যে দলটি আবেদন করেছে, সেটাও ওই পরিকল্পনার অংশ কি না, তা নিয়ে আলোচনা চলছে রাজনৈতিক মহলে। বিডিপির সঙ্গে সম্পৃক্ততা জামায়াত স্বীকার করছে না। তবে নতুন দলটির নেতারা সবাই জামায়াত–শিবিরের নেতা।

রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধনের জন্য বিডিপির একটি প্রতিনিধিদল বুধবার ইসিতে গিয়ে আবেদন করে। আবেদনের সঙ্গে শর্তানুযায়ী দলের গঠনতন্ত্র, নির্দিষ্টসংখ্যক কমিটির তালিকা ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ জমা দেয়।  

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, হঠাৎ আত্মপ্রকাশ করা বিডিপির চেয়ারম্যান এ কে এম আনোয়ারুল ইসলাম (চান) ও সেক্রেটারি জেনারেল নিজামুল হক (নাঈম)। আনোয়ারুল ইসলাম একসময় ছাত্রদল করতেন। আর নিজামুল হক ছাত্রশিবির করতেন। পরে দুজনেই জামায়াতের রুকন (শপথধারী সদস্য) এবং ঢাকা মহানগরীর মজলিশে শুরার সদস্য হন। তাঁরা এখনো জামায়াতে ইসলামীতেই আছেন।

ইসিতে নিবন্ধনের আবেদনপত্র জমা দেওয়ার পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে পড়েন বিডিপির নেতারা। এ সময় দলটির চেয়ারম্যান আনোয়ারুল ইসলাম দাবি করেন, জামায়াতের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক নেই। তাঁরা দেশের সংবিধান মেনে রাজনীতিতে এসেছেন। সংবিধানের প্রতিটি শব্দ তাঁরা সম্মান করেন এবং সেটা লালন করেই রাজনীতি করেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের পরে জন্ম নেওয়া ব্যক্তিদের নিয়ে বিডিপি গঠন করা হয়েছে।

জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল। ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৩ সালে দলটির নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। এরপর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর দলটির নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে ইসি। এ বিষয়ে একটি মামলা এখনো উচ্চ আদালতে বিচারাধীন।

আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে বুধবার দুপুরে নিবন্ধনের জন্য আবেদনপত্র জমা দেন বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টির (বিডিপি) নেতারা
তবে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এ অবস্থায় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে জামায়াত কোনো সমঝোতা বা রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে বিডিপি নামে দল গঠন করেছে কি না, এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা শুরু হয়েছে। কয়েক মাস আগে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমিরদের একজন সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেন। সর্বশেষ নতুন দল বিডিপি নিবন্ধনের আবেদন করলে নতুন করে আলোচনায় আসে জামায়াত।

যদিও জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের দাবি করেন, জামায়াত বিকল্প কোনো নামে রাজনৈতিক দল করার সিদ্ধান্ত নেয় নি।

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, বিডিপির চেয়ারম্যান আনোয়ারুল ইসলাম পেশায় আইনজীবী। তাঁর গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের নান্দাইল পৌরসভার চারি আনি পাড়ায়। তিনি ১৯৯০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জহুরুল হক ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রদল থেকে ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। তাঁর বড় ভাই এ কে এম রফিকুল ইসলামও বিএনপির সৌদি আরব (পূর্বাঞ্চল প্রদেশ) শাখার সভাপতি ছিলেন। তাঁর স্ত্রী ফরিদা ইয়াসমিন ২০১৪ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। আনোয়ারুল ছাত্রদল থেকে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে কিছুদিন যুক্ত থাকলেও পরে ঢাকায় আইন পেশায় গিয়ে জামায়াতে যোগ দেন। বর্তমানে তিনি জামায়াতের ঢাকা মহানগর কমিটির মজলিশে শুরার সদস্য।

বিডিপির সেক্রেটারি জেনারেল নিজামুল হক ছাত্রশিবিরের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ছিলেন। তিনি ২০১১ সালে শিবিরের কেন্দ্রীয় কমিটিতে দাওয়াহবিষয়ক সম্পাদক হন, পরের কমিটিতে আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন।

নিবন্ধনের আবেদনে বিডিপির কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগর কার্যালয় হিসেবে নয়াপল্টনে ‘চায়না টাউন’ নামে একটি বহুতল ভবনের ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে। আবেদনের সঙ্গে ১৫ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটির তালিকা দেওয়া হয়। এ কমিটিকে বিডিপির ‘জাতীয় স্থায়ী কমিটি’ বলে উল্লেখ করা হয়। ১৫ সদস্যের স্থায়ী কমিটিতে যাঁরা আছেন, তাঁদের অধিকাংশই জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় কমিটির কোনো না কোনো পর্যায়ের নেতা ছিলেন। কেউ কেউ পরবর্তী সময়ে জামায়াতের শপথধারী রুকন বা সদস্য হন। তাঁদের একজন রাশেদুল ইসলাম (রানা) এক কমিটিতে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণবিষয়ক সম্পাদক ও পরে ছাত্রকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। আরেকজন রিয়াদ হোসাইন, যিনি একসময় শিবিরের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ছিলেন।

আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে বুধবার দুপুরে নিবন্ধনের জন্য আবেদনপত্র জমা দেন বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টির (বিডিপি) নেতারা
জানা গেছে, ইসিতে বিডিপির ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ কমিটির পৃথক তালিকাও জমা দেওয়া হয়। তাতে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ সভাপতি পদে মনির উদ্দিন (মনি) ও সাধারণ সম্পাদক পদে রেজাউল করিমের নাম রয়েছে। মনির উদ্দিন ছাত্রশিবিরের ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) সভাপতি ও পরে কেন্দ্রীয় হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট (এইচআরডি) সম্পাদক ছিলেন। রেজাউল করিমও ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা।

মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার জন্য ক্ষমা চাওয়া এবং দলের বিলুপ্তিসহ সংস্কার আনতে ব্যর্থ হয়ে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে জামায়াতের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক পদত্যাগ করেন। এরপর বেশ চাপে পড়ে জামায়াত। তখন দলটির কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে নেতা-কর্মীদের আশ্বস্ত করা হয়েছিল যে একটি নতুন সংগঠন গড়া হচ্ছে। এ লক্ষ্যে পাঁচ সদস্যের কমিটি কার্যক্রম শুরু করেছে।

ওই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই বিডিপি নামে নতুন দল গঠন করে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল হালিম বলেন, নতুন দল করলে জামায়াত ঘোষণা দিয়েই করত। জামায়াত নিষিদ্ধ দল নয় এবং দলের নিবন্ধন বাতিলের বিরুদ্ধে করা মামলা এখনো সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন। এ অবস্থায় অনেকে না বুঝে নতুন দলটি জামায়াতের বলে উদ্দেশ্যমূলক প্রচার চালাচ্ছে।

তবে জামায়াতের ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র বলছে, বিডিপির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার না করলেও দলটি নিবন্ধন পেলে আগামী সংসদ নির্বাচনে নতুন এই দলের প্রতীকে (আপেল বা আনারস) জামায়াত নির্বাচন করতে পারে, এমন গুঞ্জনও উঠেছে। অবশ্য সেটা নির্ভর করবে নতুন দলটি নিয়ে সরকারের মনোভাব এবং বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক কোন দিকে গড়ায় তার ওপর।