ধর্মীয় বেশভূষার আড়ালে অপহরণ করতো মামুন!

ধর্মীয় বেশভূষার আড়ালে অপহরণ করতো মামুন!
নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলা কাগজ : ‘মুফতি মামুন’ ওরফে ল্যাংড়া মামুন। এক পা নেই, তাতে তার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডও থেমে নেই। ধর্মীয় পোশাকে তাকে দেখলে যে কেউই প্রথমে শান্তশিষ্ট মানুষ হিসেবেই ধরে নেবেন। কিন্তু সে পটুয়াখালীর অপরাধ জগতের শীর্ষস্থানীয় নেতা। গ্যাংয়ের তিন সদস্যসহ মামুনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিএমপি)। বুধবার (২০ এপ্রিল) দুপুরে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো : অপহরণ চক্রের মূল হোতা ল্যাংড়া মামুন ওরফে মুফতি মামুন, পিচ্চি রানা, বিআরটিসির গাড়িচালক জসীমউদ্দীন মৃধা এবং আশিকুর রহমান। পুলিশ জানায়, গত ১১ এপ্রিল সন্ধ্যায় অপহরণ করা হয় পটুয়াখালীর ব্যবসায়ী শিবু লাল দাসকে। তিনি গলাচিপা থেকে নিজ গাড়িতে পটুয়াখালী ফিরছিলেন। পথে গাড়ি ও চালকসহ অপহরণকারীদের কবলে পড়েন তিনি। ওইদিন রাতেই তার স্ত্রীর কাছে ২০ কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। তা না হলে শিবু লাল দাসের লাশ সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হবে বলে হুমকি দেয় অপহরণকারীরা। অপহরণের প্রায় ২৬ ঘণ্টা পর ১২ এপ্রিল রাত ১১টায় তাদের দুজনকে হাত-পা ও মুখ বাঁধা বস্তাবন্দি অবস্থায় পটুয়াখালীর এসপি কমপ্লেক্স শপিং সেন্টারের আন্ডার গ্রাউন্ড থেকে উদ্ধার করে জেলা পুলিশ। হাফিজ আক্তার বলেন, ‘ঘটনার পর অপহরণকারীদের ধরতে মাঠে নামে পুলিশ। পটুয়াখালী জেলা পুলিশের অনুরোধে ঢাকার ডিবির একাধিক টিম কাজ শুরু করে। তারই ধারাবাহিকতায় অপহরণের সঙ্গে জড়িত ল্যাংড়া মামুনসহ চারজনকে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘১৯ এপ্রিল দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাজধানীর মিরপুর, ভাটারা এবং গুলিস্তান এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে ডিবি গুলশান বিভাগ। তাদের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়ে ব্যবহার করা প্রাইভেটকার, মোবাইল ফোন, গামছা ও চার হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়েছে।’ অপহরণের পরিকল্পনা : পটুয়াখালী লঞ্চঘাটের কাছাকাছি ল্যাংড়া মামুনের গার্মেন্টস অফিসে বসে গত ফেব্রুয়ারি মাসে শিবু লাল দাসকে অপহরণের নীলনকশা আঁকা হয়। এতে অংশ নেয় ল্যাংড়া মামুন, পিচ্চি রানা, পাভেল ও বিআরটিসির ড্রাইভার জসিম। কয়েকদিন মিটিং করে কাজের পরিকল্পনা করা হয়। মিটিংয়ে ঢাকা থেকে মাঝে মাঝে ছুটি নিয়ে যোগ দেয় জসিমউদ্দিন মৃধা এবং তার ভাই গাড়ির দালাল আশিক মৃধা। অপহরণে ব্যবহার করতে ১০ হাজার টাকা অ্যাডভান্স দিয়ে এক সপ্তাহের জন্য গাড়ি ভাড়া করা হয় ঢাকা থেকে। সেই গাড়ি ঢাকা থেকে যায় পটুয়াখালী। অপহরণের পর মুক্তিপণ দাবি, নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ ইত্যাদি কাজের জন্য ঢাকার সাভার থেকে কেনা হয় পাঁচটি বাটন ফোন। বেশি দাম দিয়ে ইতোমধ্যে অন্যজনের নামে নিবন্ধন করা সিম কেনা হয় জেলা সদর থেকে। স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা হয় একটি খেলনা পিস্তল, দুইটি সুইচ গিয়ার, তিনটি চাপাতি এবং গরু জবাই করার একটি বড় ছুরি। পরে একাধিক দিন রেকি করে অপহরণের কাজটি করা হয় ১১ এপ্রিল রাত সাড়ে ৮টায়। যেভাবে অপহরণ করা হয় : ১১ এপ্রিল দুপুরে পটুয়াখালী এয়ারপোর্টের কাছে মিলিত হয় অপহরণকারীরা। কার কোথায় কী দায়িত্ব তা নির্ধারণ করে দেয় ল্যাংড়া মামুন ও পিচ্চি রানা। ভুক্তভোগীদের গতিবিধি মোবাইলে জানানোর জন্য পিচ্চি রানা তার মোটরসাইকেলে ল্যাংড়া মামুনকে নিয়ে চলে যায় গলাচিপা ঘাটে। পটুয়াখালী-গলাচিপা সড়কে প্রাভেটকার ও ট্রাক্টর আড়াআড়িভাবে রেখে আশিক মৃধা, পাভেল, হাবিব, সোহাগ ওই ব্যবসায়ীর জিপে উঠে যায়। গাড়িতে উঠেই বিল্লাল, পাভেল, সোহাগ, আশিক ব্যবসায়ী ও চালককে বেঁধে ফেলে। গামছা, টিস্যু পেপার এবং স্কচটেপ দিয়ে মুখ, হাত-পা বেঁধে চলতে থাকে চড়-থাপ্পড়, কিলঘুষি। সঙ্গে থাকা খেলনা পিস্তল ও ছোরা-চাকু দিয়ে ভয় দেখানো চলতে থাকে। বরগুনার আমতলী এলাকার গাজিপুরায় গিয়ে ভিকটিমের জিপ গাড়ি থেকে তাদের তোলা হয় ঢাকা থেকে নিয়ে যাওয়া কারটিতে।‌ সেখানে ভিকটিম দুই জনকে আরও ভালোভাবে বেঁধে প্লাস্টিকের বস্তায় ঢোকানো হয়। ব্যবসায়ীর জিপটিকে আমতলীর একটি ফিলিং স্টেশনে ফেলে আসে। রাত আনুমানিক সাড়ে ১১টার দিকে ল্যাংড়া মামুন ও পিচ্চি রানা পটুয়াখালীর বাঁধঘাট এলাকায় ব্যবসায়ীকে অপহরণ করা গাড়িটি বুঝে নেয়। গাড়ি চালাতে থাকে ল্যাংড়া মামুন নিজেই। ল্যাংড়া মামুন সোজা নিয়ে যায় তার এইচডি রোডের নিজস্ব মেশিনঘর নামে একটি টর্চার সেলে। পরে নিয়ে যাওয়া হয় এসপি কমপ্লেক্স সুপার মার্কেটের আন্ডারগ্রাউন্ডের অস্থায়ী সেলে। সেখানে রাতভর চলে নির্যাতন। রাত ১টা ৪৫ মিনিটে রানার নির্দেশ মতো বিল্লাল ব্যবসায়ীর সিম থেকে তার স্ত্রীকে ফোন দিয়ে পরের দিন দুপুর ২টার মধ্যে ২০ কোটি টাকা মুক্তিপণ দিতে বলা হয়। মুক্তিপণের টাকা না দিলে এবং বিষয়টি পুলিশকে জানালে শিবু লালকে হত্যা করে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হবে বলেও হুমকি দেয় অপহরণকারীরা। ধর্মীয় বেশভূষার আড়ালে অপরাধ জগতের নেতা ল্যাংড়া মামুন : ল্যাংড়া মামুন ওরফে মুফতি মামুনের ডান পা নেই। কৃত্রিম পা ব্যবহার করে হাঁটে। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় তার ডান পা উরু পর্যন্ত কেটে ফেলা হয়। তার বাবা একজন মুফতি হওয়ায় তার পড়াশোনাও হাফেজি এবং নূরানী ধারায়। পরে জড়িয়ে পড়ে অপরাধ জগতে। মাথায় টুপি, মুখভর্তি দাড়ি, পাজামা ও পাঞ্জাবি পরা মিষ্টভাষী মামুনকে দেখলে বোঝার উপায় নেই সে অপরাধী। আপন বোন-জামাইয়ের টাকায় পটুয়াখালী জেলা শহরে একাধিক দোকান এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক হয় সে। মাওলানা হিসেবে তার বাবার সুখ্যাতি এবং পঙ্গুত্বের কারণে তার বিরুদ্ধে মুখ খোলে না অনেকেই। তার বিরুদ্ধে মারামারি, মাদক এবং অপহরণের একাধিক মামলা রয়েছে। বাবার সুখ্যাতি এবং নিজের পঙ্গুত্বের দোহাই দিয়ে বিভিন্ন ভান-ভনিতা করে অনেক অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার চেষ্টা করেছে মামুন। অপহরণ বাণিজ্য চালানোর জন্য পটুয়াখালীতে গড়ে তুলেছে দুইটি টর্চার সেল। সে একজন মাদকসেবী ও মাদক ব্যবসায়ী। কৃত্রিম পায়ের ফোকরে হাজার হাজার পিস ইয়াবা লুকিয়ে সে নিয়ে যেতো এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। পিচ্চি রানা বিভিন্ন টোল প্লাজায় টোল কালেকশনের কাজ করে, বিটিআরসির ড্রাইভার জসিম উদ্দিন মৃধা আর আশিক দীর্ঘদিন ধরে রেন্ট-এ-কারের দালালি করে।