জালিয়াতি নিয়েই ছিলেন অগ্রণীর সাবেক এমডি মোহাম্মদ শামস্‌-উল!

জালিয়াতি নিয়েই ছিলেন অগ্রণীর সাবেক এমডি মোহাম্মদ শামস্‌-উল!

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ ও আওয়ার ডন : জালিয়াতি যেনো তাঁর রক্তে। তাইতো অগ্রণী ব্যাংকে যোগ দিয়েই খেয়েছিলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তাড়া। আর এরপরের ঘটনাগুলো তো ‘ইতিহাস’। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক খাতের অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডকে লেফাফাদুরস্ত করতে যেনো সাবেক এমডি ও সিইও মোহাম্মদ শামস্‌-উল ইসলামের প্রতিযোগিতা ছিলো। যেখানে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষকেরও কোনও কথা শুনেন নি। ফলে ম্যাগপাই নিটওয়্যারের এমডির মাধ্যমে তাঁর কানাডায় টাকা পাচার করে বেগম পাড়ায় বাড়ি করা, পেনশনের টাকায় জালিয়াতি, ঋণ দিয়ে তা ফেরতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ না করা, এক অডিটেই ধরা পড়া ৯ শ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি, এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা পরিচালনায় অনিয়ম, ব্যাংকের সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় অবস্থিত এক্সচেঞ্জ হাউসের প্রধান নির্বাহী নিয়োগে অনিয়ম, বিমানবন্দরের বুথের পাসপোর্ট এনডোর্সমেন্ট মাশুলে অনিয়ম, ব্যাংকের আমানতকারীদের স্বার্থ পরিপন্থি কাজ করা, বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষকের কথা না শুনে বিশেষ গ্রুপ ও বিশেষ প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে জালিয়াতি, গাড়ি ঠিক করার নামে অর্থ নয় ছয়, কম্বল ক্রয়ের নামে অনিয়ম, সিএসআরের অর্থে জালিয়াতি, আত্মীয়কে এজেন্ট ব্যাংকে নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে অনিয়ম, সিলেটের প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে জালিয়াতির ঘটনাগুলো ‘করেছেন’ অগ্রণী ব্যাংকের সদ্য বিদায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ শামস্‌-উল ইসলাম।

জালিয়াতিগুলোর ব্যাপারে জানতে সোমবার (৩ অক্টোবর) অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক এমডি মোহাম্মদ শামস্‌-উল ইসলাম ইসলামের মুঠোফোনে ফোন দেওয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেন নি। পরে খুদে বার্তা পাঠিয়ে তাঁকে কল দেওয়া হয়। এরপরও নিরুত্তর থাকেন মোহাম্মদ শামস্‌-উল ইসলাম।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংকের নির্ভরযোগ্য সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মোহাম্মদ শামস্‌-উল ইসলাম অগ্রণী ব্যাংকের এমডি ও সিইও থাকা অবস্থায় ব্যাংকটির বিরুদ্ধে অনেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় নি। এক্ষেত্রে প্রভাবশালীদের চাপ ছিলো। কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে গেলেই বিভিন্ন সংস্থা থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে সরাসরি ফোন আসতো। এক্ষেত্রে শামস্‌-উল ইসলাম জামায়াতের লোক হওয়া সত্ত্বেও জালিয়াতি করার স্বার্থে বর্তমান বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী এবং তাঁদের সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে এসব ম্যানেজ করার চেষ্টা করতেন এবং ম্যানেজ করতেন। এক্ষেত্রে তিনি ক্ষমতাসীন দলের লোকজনকে ঋণ বা এ ধরনের সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে তাঁর কাজ হাসিল করে নিতেন। আর এ কারণে অগ্রণী ব্যাংকে এক রকম বুদবুদের সৃষ্টি হয়েছে। আর বর্তমানে যেহেতু শামস্‌-উল ইসলাম এমডির পদে নেই, এখন অগ্রণী ব্যাংকের বড় জালিয়াতিগুলো নিরীক্ষা ও তদন্ত প্রতিবেদনে বের হয়ে আসলে ব্যাংকটির অনেক ঋণ খেলাপি হয়ে পড়তে পারে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকে অধিক হারে প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) রক্ষা করতে হবে ব্যাংকটিকে। ফলে লোকসানের মুখে পড়বে অগ্রণী ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, মোহাম্মদ শামস্‌-উল ইসলাম এমডি থাকাকালীন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংকের ১৯ শাখা থেকে ৯ শ কোটি টাকা ঋণ বিতরণে অনিয়মের তথ্য পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ  ব্যাংক পরিচালিত নিরীক্ষায় বেরিয়ে আসা ওই অনিয়মের ব্যাপারে অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

জানা গেছে, দেশের ২৬টি প্রতিষ্ঠানকে ঋণের নামে দেওয়া এমন অনিয়মকে মন্দ ঋণ বলছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থাৎ এসব ঋণের অর্থ ফিরে আসার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। আর ওই অনিয়মের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে দায়িত্বরত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস্‌-উল ইসলাম বরাবর পাঠানো দুদকের চিঠিতে যেসব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়া হয়েছে সেগুলোর বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত, বিভিন্ন সময়ে দেওয়া ঋণের পরিমাণ, ঋণের শর্ত ও ঋণের বর্তমান পরিস্থিতি, বাংলাদেশ কর্তৃক অডিট আপত্তিসহ অনিয়ম এবং দুর্নীতি সংশ্লিষ্ট নথিপত্র তলব করা হয়।

দুদক জানায়, প্রথমে বেশ কয়েকবার তাগাদা দেওয়ার পরও নথিপত্র দুদককে দেয় নি অগ্রণী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। পরে কিছু কাগজ দেওয়া হয়। এরপর অন্যান্য কাগজগুলো দেওয়া হয়।

এ ব্যাপারে দুদকের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অগ্রণীর সাবেক এমডির জোর ছিলো কোথায়?

অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ বাঙলার কাগজ ও ডনকে বলেন, অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক এমডির বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত চলছে। অভিযুক্ত হলে আমরা তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করবো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বাঙলার কাগজ ও ডনকে বলেন, যে কোনও ব্যাংকেরই শীর্ষ পদ খুবই সেনসেটিভ পদ। এ পদে থেকে যা ইচ্ছে, তাই করা যায় না। তাই এ পদের লোকজনকে আরও বেশি দায়িত্বশীল হওয়া উচিত।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সেন্ট্রাল অ্যাকাউন্টস ডিভিশনে পেনশনের টাকা নিয়ে অনিয়ম করা হয়েছে। ৩০২ কোটি টাকা বিল হিসেবে উপস্থাপনে ব্যর্থ হয়েছে ব্যাংকটি। 

এ ছাড়া একই ডিভিশন থেকে ব্যাংকের ২৫৩ কোটি টাকা শেয়ারবাজারের অতালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করায় পুরো অর্থই ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে ব্যাংক। এর বাইরে ব্যাংকের বি-ওয়াপদা করপোরেট শাখায় সাড়ে ৩৭ কোটি টাকার ঋণে অনিয়ম করা হয়েছে। আলভি স্পিনিং মিলসের কাছে ব্যাংকের পাওনা এসব টাকা আদায় অনিশ্চিত এবং ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। অথচ পাওনা আদায়ে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করে নি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। একই শাখায় আরও প্রায় ৪ কোটি টাকার ঋণ অনিয়ম করা হয়েছে। মেসার্স ডোমার স্পেশালাইজড কোল্ড স্টোরেজের অনুকূলে দেওয়া এসব ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ, সীমাতিরিক্ত ও ক্ষতিমানে শ্রেণিকৃত। ঋণ আদায়ে ব্যাংক কোনও ব্যবস্থাই নেয় নি। দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয় নি। তবে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বলছে, টাকা আদায়ের চেষ্টা অব্যাহত আছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, অগ্রণী ব্যাংকের রমনা করপোরেট শাখার ৩ গ্রাহক প্রতিষ্ঠান ঋণের নামে নিয়ে গেছে প্রায় ৫২ কোটি টাকা। এগুলো হলো : আহমেদ স্পিনিং মিলসের অনুকূলে ৩০ কোটি টাকা, রবি ফ্যাশনের অনুকূলে প্রায় ৬ কোটি টাকা এবং মেসার্স হেলেনা এন্টারপ্রাইজের অনুকূলে ১৬ কোটি টাকা। একইভাবে আমিন কোর্ট করপোরেট শাখার ৪ গ্রাহক প্রতিষ্ঠান ঋণের নামে নিয়ে গেছে প্রায় সাড়ে ৫৪ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো : মেসার্স প্যান্ডোরা ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের অনুকূলে ৬ কোটি টাকা, মেসার্স বেস্ট ট্রেড লিংকের অনুকূলে সাড়ে ২৪ কোটি টাকা, মেসার্স রেদোয়ান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের অনুকূলে ১৪ কোটি টাকা এবং ইউনি অ্যালায়েন্স জুট ইন্ডাস্ট্রিজের অনুকূলে ১০ কোটি টাকা। এসব ঋণের পুরোটাই আদায় অনিশ্চিত হয়ে মন্দ খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে আরও দেখা গেছে, ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্রেডিট ডিভিশন-১ এর গ্রাহক প্রতিষ্ঠান মেসার্স লীনা পেপার মিলসের অনুকূলে প্রায় সাড়ে ৪৪ কোটি টাকা, ঢাকার চক বাজার শাখার গ্রাহক প্রতিষ্ঠান মেসার্স শহীদ স্টোরের অনুকূলে ১ কোটি টাকা, গ্রিনরোড করপোরেট শাখার গ্রাহক প্রতিষ্ঠান মৌরিশাস ইন্টারকন্টিনেন্টালের অনুকূলে ৩৪ কোটি টাকা, কক্সবাজার শাখার গ্রাহক প্রতিষ্ঠান মেসার্স কর্ণফুলী সি ফুডসের অনুকূলে সাড়ে ৪ কোটি টাকা, পুরানা পল্টন করপোরেট শাখার গ্রাহক প্রতিষ্ঠান মেসার্স গ্লোবাল জুট ইন্ডাস্ট্রিজের অনুকূলে প্রায় ১২ কোটি টাকা, শান্তিনগর শাখার গ্রাহক মোসাম্মৎ তাহমিনা ইসলামের অনুকূলে প্রায় সাড়ে ৮ কোটি টাকা, সদরঘাট করপোরেট শাখার গ্রাহক প্রতিষ্ঠান মেসার্স জুয়েল ক্লথ স্টোরের অনুকূলে দেড় কোটি টাকা, বরগুনা শাখার গ্রাহক প্রতিষ্ঠান এমআর ট্রেডিং কোংয়ের অনুকূলে প্রায় ৬৫ কোটি টাকা, ঢাকার ওয়াসা করপোরেট শাখার গ্রাহক প্রতিষ্ঠান অ্যাপোলো ফার্মাসিউটিক্যালস ল্যাব. লিমিটেডের অনুকূলে প্রায় ৩ কোটি টাকা, ঢাকার শ্যামলী শাখার গ্রাহক প্রতিষ্ঠান মেসার্স ডিজিটাল ব্রিকস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের অনুকূলে প্রায় ৬ কোটি টাকার ঋণ অনিয়ম করা হয়েছে। 

এ ছাড়া কয়েক দিনের মধ্যেই পুরাতন গাড়ি ঠিক করার নামে প্রায় ২০ লাখ টাকা নয় ছয় এবং কম্বল ক্রয়ের নামে প্রায় দেড় কোটি টাকার অনিয়ম করেছেন অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক এমডি মোহাম্মদ শামস্‌-উল ইসলাম।

এজেন্ট ব্যাংকিংসহ বেশ কয়েকটি খাতে জালিয়াতি : অগ্রণী ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা পরিচালনায় জালিয়াতি খুঁজে পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই সেবা পরিচালনা করা হচ্ছে দুয়ার সার্ভিসেস লিমিটেডের মাধ্যমে। উদ্বৃত্ত আমানত থাকার পরও এই সেবার মাধ্যমে আমানত সংগ্রহ করা হচ্ছে, যাতে প্রতি মাসে তিন-চার কোটি খরচ বেড়েছে। আবার ব্যাংকের সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় অবস্থিত এক্সচেঞ্জ হাউসের প্রধান নির্বাহী নিয়োগেও অনিয়ম পাওয়া গেছে। বিমানবন্দরের বুথের পাসপোর্ট এনডোর্সমেন্ট মাশুলও বেশি আদায় করা হয়েছে।

এমন তথ্যের প্রেক্ষিতে ব্যাংকটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস্‌-উল ইসলামকে চিঠি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। বলে, এসব অনিয়ম ব্যাংকের এমডির প্রত্যক্ষ মদদ বা প্রশ্রয়ে সংঘটিত হয়েছে। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের নির্দেশনা বারবার লঙ্ঘন করে অনিয়মের মাধ্যমে আমানতকারীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। এসব অনিয়মের বিষয়ে ব্যাংকটির সাবেক এমডি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বারবার মিথ্যা তথ্য প্রদান করেছেন। সার্বিক বিবেচনায় ব্যাংকের সাবেক এমডির কার্যক্রম আইনকানুন না মানা (নন–কমপ্লায়েন্ট) এবং তাঁর ভূমিকা আমানতকারীদের স্বার্থের পরিপন্থী মনে হয়েছে।

এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে অনিয়ম : অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় ব্যাংকের জন্য ভাড়া করা ভবনটি ব্যাংকের বিভিন্ন বিভাগকে বরাদ্দ প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু এই নির্দেশনা লঙ্ঘন করে এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার মাস্টার এজেন্ট দুয়ার সার্ভিসেস লিমিটেডকে জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এমনকি এই জায়গা বরাদ্দের বিষয়টি দুয়ার সার্ভিসেস ও অগ্রণী ব্যাংকের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছে, তাতেও উল্লেখ নেই। এরপরও দুয়ার সার্ভিসেসের ব্যবহৃত জায়গার ভাড়া ব্যাংক পরিশোধ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠিতে বলা হয়েছে, এটা ব্যাংকের অর্থ তছরুপের শামিল। এজন্য প্রতি মাসে ২ লাখ ২ হাজার ১৫০ টাকা ভাড়া দেওয়া হয়েছে। এর ফলে গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১ কোটি ১৮ লাখ টাকা ভাড়া প্রদানের মাধ্যমে ব্যাংকের আর্থিক ক্ষতি সাধন করেছেন ব্যাংকটির সাবেক এমডি। ব্যাংকের সাবেক এমডির ক্ষমতাবহির্ভূত এমন কর্মকাণ্ড আমানতকারীদের স্বার্থের পরিপন্থী বলেই জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

২০২১ সালের অক্টোবর মাসে অগ্রণী ব্যাংকের অলস তারল্য ছিলো ৩০ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা। ব্যাংকের আমানত উদ্বৃত্ত ছিল প্রায় ৪৫ শতাংশ। এরপরও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ব্যাংকটি আমানত সংগ্রহ করছে এবং এ খাতে মাসে তিন-চার কোটি টাকা খরচ বৃদ্ধির মাধ্যমে ব্যাংকের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ব্যাংকিং সেবাবঞ্চিত এলাকায় সেবা পৌঁছে দেওয়া এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার লক্ষ্য। তবে অগ্রণী ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা দেওয়া হচ্ছে ঢাকার গুলশান, বনশ্রী, যাত্রাবাড়ী এলাকায়। এসব এলাকায় ১৫টি এজেন্ট নিয়োগ করা হয়েছে। এই ১৫ এজেন্টের মধ্যে ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিকট আত্মীয়দের আছে ছয়টি, যার মধ্যে এমডির সহকারী একান্ত সচিবের স্ত্রী ও বোন, বোর্ড ডিভিশনের সচিবের স্ত্রী, বোর্ড ডিভিশনের কর্মকর্তার বোনও আছেন। এই ছয় এজেন্টকে কয়েক বছরে প্রায় ৬ কোটি ২২ লাখ টাকা কমিশন দিয়েছে অগ্রণী ব্যাংক।

বিমানবন্দর বুথে যতো অনিয়ম : বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অগ্রণী ব্যাংকের এমডি ক্ষমতাবহির্ভূতভাবে ব্যাংকের বিমানবন্দর বুথের সংস্কারকাজের নামে ৫১ লাখ ৪৮ হাজার ৩৪২ টাকার বিল অনুমোদন করেন। এই সংস্কারকাজের সপক্ষে ব্যাংক প্রমাণ দিতে পারে নি। 

এ ছাড়া বিমানবন্দর বুথের ভল্টে ৮ লাখ ৫৬ হাজার ৫৭৫ টাকার তহবিল ঘাটতিও পাওয়া যায়। ভল্টে টাকার ঘাটতির মতো সংবেদনশীল বিষয়েও সাবেক এমডির ভূমিকা ব্যাংকের স্বার্থপরিপন্থী বলে প্রতীয়মান হয়েছে। বিমানবন্দর বুথের বৈদেশিক মুদ্রা বিক্রয়ের এনডোর্সমেন্ট মাশুলপ্রতি গ্রাহকের কাছ থেকে ১১০ টাকার পরিবর্তে ১৩০ টাকা আদায় করা হয়। আর এই অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণপ্রক্রিয়ার বৈধতা দিতে ব্যাংকটির সাবেক এমডি বিভ্রান্তিকর ও মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন।

বিশেষ প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে জালিয়াতি : রাজধানীর উত্তরায় অবস্থিত ম্যাগপাই গ্রুপের পোশাক প্রতিষ্ঠান ম্যাগপাই নিটওয়্যার লিমিটেডকে মতিঝিলের প্রিন্সিপাল শাখা থেকে প্রথম ঋণ মঞ্জুর করে অগ্রণী ব্যাংক। এরপর থেকে ওই গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৩০৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকা ঋণ সুবিধা দেওয়া হয়। কিন্তু পরিশোধ সূচি অনুযায়ী গ্রাহক ঋণটি পরিশোধ করতে না পারায় তা পুনর্বিন্যাস করা হয়। 

তা ছাড়া তহবিল খরচ অনুযায়ী, সুদহার নির্ধারণ এবং ঋণের সুদ ব্লকড হিসেবে স্থানান্তরের সুবিধা দেওয়া হলেও ২০১৭ সালে পর্যন্ত ঋণের অর্থ নিয়মিত পরিশোধ করতে পারে নি ম্যাগপাই নিটওয়্যার। তখন সুদাসল বেড়ে ঋণের পরিমাণ ৩১৫ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়।

২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে অগ্রণী ব্যাংকের ৫৯১তম সভায় ম্যাগপাই নিটওয়্যারের ঋণটি আবারও পুনর্বিন্যাস করার প্রস্তাব করা হয়। ওই সভায় পর্ষদে উপস্থাপিত স্মারকে বলা হয়, ম্যাগপাই নিটওয়্যার ২০১৭ সালে ১৫৩ কোটি ৬২ লাখ টাকা রপ্তানি থেকে আয় করেছে। বিষয়টি নজরে আসে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষকের। পরে বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের অফসাইট সুপারভিশন বিভাগের নজরেও আসে। তাঁদের কাছে বিষয়টি এমনভাবে প্রতীয়মান হয় যে, গ্রাহক ইচ্ছাকৃতভাবে ঋণের অর্থ পরিশোধ করছে না। অথবা গ্রাহকের রপ্তানি আয়ের তথ্য-উপাত্ত প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক সক্ষমতার প্রকৃত চিত্র প্রমাণ করে না। অর্থাৎ এখানে ভুয়া নথিপত্র উপস্থাপন করে প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক সক্ষমতা প্রমাণের চেষ্টা করা হয়েছে।

এত কিছুর পরও অগ্রণী ব্যাংক পর্ষদ সভায় ম্যাগপাই নিটওয়্যারের চারটি মেয়াদি ঋণের প্রিন্সিপাল অ্যামাউন্ট বা আসল তিন মাসের কিস্তিতে বছরে মোট ২১ কোটি টাকা করে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত পরিশোধ করার সুযোগ দেয়। অবশিষ্ট অর্থ পরিশোধের জন্য ২০২৭ সালের সেপ্টেম্বরের ১০ তারিখ পর্যন্ত সময় দিয়ে ঋণটি পুনর্বিন্যাসের অনুমোদন দেওয়া হয়। এ ঋণে আসলের পরিমাণ ১৬৮ কোটি ২৩ লাখ টাকা।

এ ছাড়া সুদ বাবদ প্রায় ১৪৭ কোটি টাকা ব্লকড হিসাবে রেখে সাত শতাংশ সুদে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত কেবল সুদের অর্থ ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে আদায় এবং অবশিষ্ট দায় ২০২৭ সালের সেপ্টেম্বরের ১০ তারিখের মধ্যে পরিশোধের জন্য কিস্তি পুনর্বিন্যাস করার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষক সিরাজুল ইসলাম আপত্তি উত্থাপন করেছিলেন। কিন্তু ওই আপত্তি আমলে না নিয়ে ঋণটি পুনর্বিন্যাসের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে। এমনকি পর্ষদের ওই সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন পাওয়া সাপেক্ষে এ ধরনের পুনর্বিন্যাসকরণ ও সুদের হার কমানোর প্রস্তাব অনুমোদন করা হলেও পরবর্তী সময়ে অনুষ্ঠিত ৫৯২তম সভায় ওই শর্তটি রহিত করা হয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপার্টমেন্ট অব অফসাইট সুপারভিশনের এক পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, সামগ্রিক বিবেচনায় যথাসময়ে প্রকল্প স্থাপনে ব্যর্থ, উৎপাদনে অক্ষম, ঋণ পরিশোধের সক্ষমতাহীন একটি প্রতিষ্ঠানকে বড় অঙ্কের ঋণ দেওয়ার মাধ্যমে অগ্রণী ব্যাংকে গুরুতর অনিয়ম সংগঠিত হয়েছে; যা ব্যাংক এবং আমানতকারীদের স্বার্থের পরিপন্থী।

বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের নজরে আনেন অগ্রণী ব্যাংকে নিযুক্ত পর্যবেক্ষক। এর পরপরই জরুরি ভিত্তিতে ম্যাগপাই নিটওয়্যারকে ঋণ দেওয়ার সঙ্গে জড়িত অগ্রণী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য এফআইসিএসডিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

সার্বিকভাবে জালিয়াতির ক্ষেত্রে অগ্রণী ব্যাংকের পূর্বসূরীদের পথেই হেটেছেন ব্যাংকটির সাবেক এমডি ও সিইও মোহাম্মদ শামস্‌-উল ইসলাম।