জালিয়াতির সহযোগী রূপালীর এমডি জাহাঙ্গীর!

জালিয়াতির সহযোগী রূপালীর এমডি জাহাঙ্গীর!

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ ও ডন : অনিয়ম ও জাল-জালিয়াতির ক্ষেত্রে সাবেক এমডিদের সহযোগী হয়ে পড়েছেন রূপালী ব্যাংকের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর। এক্ষেত্রে তিনি ২০২০ সালে ব্যাংকটিতে ডিএমডি (উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক) পদে পদোন্নতি পেয়ে সদ্য সাবেক হওয়া এমডির জালিয়াতিতে উতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। আর ২০২০ সালের আগে ব্যাংকটিতে মহাব্যবস্থাপক (জিএম) পদে থেকে হোন জালিয়াতির সঙ্গী। আবার বর্তমানে সাবেক এমডিদের ঋণ জালিয়াতিতেও তিনি একই কাজ করছেন। অর্থাৎ রূপালী ব্যাংকে আগের ৩ এমডি একটি প্রতিষ্ঠানকে পরপর জালিয়াতির মাধ্যমে যেভাবে ঋণ দিয়েছেন, তেমনি জালিয়াতি করার অভিযোগ পাওয়া গেছে মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধেও। এক্ষেত্রে রূপালী ব্যাংকের জালিয়াতি ঢাকতে আগের এমডিরা মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরকে এমডি হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সুপারিশ করেছিলেন বলেই জানা গেছে। এক্ষেত্রে তাঁরা তা করতে পেরেছেনও।

সূত্র জানায়, রূপালী ব্যাংকের নিয়োগে অনিয়ম, এলসি (আমদানির ঋণপত্র) জালিয়াতি, আইবিপি (অভ্যন্তরীণ বিল ক্রয়) জালিয়াতি এবং এলএটিআর (বিশ্বাসের ভিত্তিতে ঋণ) জালিয়াতিতে জড়িয়ে পড়েন বর্তমান এমডি মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর। মূলত একটি ব্যাংকের এমডির সহযোগী হিসেবে ডিএমডি এবং জিএম যে কোনও কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং অনেক বড় অংশীদার। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে তৎকালীন এমডি হুমায়ূন কবীরের পাশাপাশি ডিএমডি আতিকুর রহমান এবং মাইনুল হকের পাশাপাশি জিএমেরও দায় উঠে এসেছিলো। পরে জালিয়াতির মামলায় তাঁদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে।

সূত্র জানায়, জালিয়াতি ও অর্থ পাচারের অভিযোগে রূপালী ব্যাংকের সাবেক এমডি এম ফরিদ উদ্দীনকে অভিযুক্ত করে ইতোমধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে দুদক (দুর্নীতি দমন কমিশন)। আর ব্যাংকটির সাবেক এমডি আতাউর রহমান প্রধান এবং ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদের নামে দুদকে তদন্ত চলছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের আগস্টে রূপালী ব্যাংকে এমডি হিসেবে যোগ দেন আতাউর রহমান প্রধান। তিন বছরের মেয়াদ শেষে ২০১৯ সালে তিনি সোনালী ব্যাংকের এমডি হন। ২০১৬ সালের জুনে রূপালী ব্যাংকের ঋণ ছিলো ১৫ হাজার ৪২১ কোটি টাকা। আর খেলাপির পরিমাণ ছিলো ২ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা। আতাউর রহমানের মেয়াদকালে ২০১৯ সালের জুনে এ ঋণ বেড়ে হয় ২৪ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। এ সময় খেলাপি বেড়ে হয় ৪ হাজার ৩১১ কোটি টাকা। ২০১৯ সালের ব্যাংকটির এমডি হিসেবে যোগ দেন ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ। এর আগে তিনি ৩ বছর তিনি সোনালী ব্যাংকের এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদের তিন বছরের মেয়াদে গত জুনে ব্যাংকটির ঋণ বেড়ে হয় ৩৭ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা। আর খেলাপির পরিমাণ দাঁড়ায় ৬ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা।

অনিয়ম ও জাল-জালিয়াতির ব্যাপারে জানার জন্য রূপালী ব্যাংকের বর্তমান এমডি মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের মুঠোফোনে খুদেবার্তা পাঠিয়ে ফোন দেওয়া হয়। ফোনকলের একেবারে শেষপ্রান্তে কেটে দেন তিনি।

জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ বাঙলার কাগজ ও ডনকে বলেন, কারও ব্যাপারে অভিযোগ পেলে, সেই অভিযোগ অবশ্যই খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দীন আহমেদ বাঙলার কাগজ ও ডনকে বলেন, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও নজর দিতে হবে। সব ব্যাংকের ব্যাপারেই নজর দিতে হবে। তবে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর ব্যাপারে ইদানিং বেশি অনিয়মের খবর পাওয়া যাচ্ছে। এ ধরনের অনিয়ম যাতে না হয়, তা রোধ করতে হবে। 

সূত্র জানায়, রূপালী ব্যাংকে সাম্প্রতিক সময়ে বেশকিছু অনিয়ম ও জাল-জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে রয়েছে বেশকিছু পদের নিয়োগে দুর্নীতি। তবে এক্ষেত্রে কেবল দুর্নীতি করেই ক্ষান্ত হন নি ব্যাংকটির দায়িত্বপ্রাপ্তরা। তাঁরা নিয়োগে দুর্নীতির তথ্য-উপাত্ত মুছে ফেলতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যক্তিগত নথি থেকে নিয়োগ সংক্রান্ত উত্তরপত্র, নম্বর শিটসহ আনুষঙ্গিক তথ্যপত্রও উধাও করে দিয়েছেন।

এদিকে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে ই-মেইল জালিয়াতি করে বরখাস্ত হওয়া কমকর্তা, শাখা ব্যবস্থাপক থাকা অবস্থায় গ্রাহকের এফডিআর (স্থায়ী আমানত) আত্মসাৎ, ভুয়া সনদসহ অবৈধ উপায়ে পরীক্ষা দিয়ে চাকরিতে নিয়োগ পাওয়া—  এমন সব অনিয়মের সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণও মিলেছে।

ইতোমধ্যে এসব অনিয়মের ব্যাপারে একাধিকবার রূপালী ব্যাংককে সতর্ক করেছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা- বাংলাদেশ ব্যাংক।

জানা গেছে, সার্টিফিকেট জালিয়াতির মাধ্যমে এবং নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ না নিয়েও রূপালী ব্যাংকে চাকরির ঘটনা ঘটেছে।

এসব জালিয়াতিতে সাবেক এমডিদের সঙ্গে জিএম এবং ডিএমডি থাকা অবস্থায় বর্তমান এমডি জাহাঙ্গীরও জড়িত ছিলেন বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে। মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর ১৯৯০ সালে অফিসার হিসেবে রূপালী ব্যাংকে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। তাঁর বাড়ি নোয়াখালী জেলার কবিরহাট উপজেলায়।

মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের সহযোগিতায় আরও ঋণ জালিয়াতি : সাধারণভাবে যে কোনও কার্যাদেশের অগ্রগতি অনুযায়ী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয় ব্যাংক। তবে ডলি কনস্ট্রাকশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ঋণের ক্ষেত্রে এ নিয়ম মানা হয় নি। ঋণ দেওয়ার দুই বছর পরও তাঁদের কাজের সন্তোষজনক অগ্রগতি প্রতিবেদন পাওয়া যায় নি। আবার ঋণ শোধ না করলেও রূপালী ব্যাংক বারবার ঋণ দিয়েছে। রূপালী ব্যাংকের সাবেক এমডি আতাউর রহমান প্রধান পরিচালনা পর্ষদকে না জানিয়েই ডলি কনস্ট্রাকশনের নন-ফান্ডেড ঋণের ৫০ কোটি টাকা ফান্ডেড করে দেন। এ অবস্থায় গ্রাহকের কাছে পাওনা ৪৮৫ কোটি টাকা আদায়ে অনিশ্চয়তা দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে এ অর্থায়নকে গ্রাহক, শাখা কর্তৃপক্ষ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে অর্থ আত্মসাৎ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনাপত্তি ও ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন অনুযায়ী গ্রাহকের মোট ঋণসীমা হওয়ার কথা ৩৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ফান্ডেড ২৫৫ কোটি এবং নন-ফান্ডেড ৯৫ কোটি টাকা। এর আগে ২০১৯ সালেই একক গ্রাহকের ঋণসীমা অতিক্রম করে ঋণ দেওয়ায় তা সমন্বয়ের নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে ঋণ সমন্বয় তো দূরে থাক, বারবার নবায়ন ও নতুন করে সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এমনকি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে উত্থাপন ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনাপত্তি না নিয়েই ক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যাংকের তৎকালীন এমডি গ্রাহককে ৫০ কোটি টাকার ঋণ সুবিধা দেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, নির্দিষ্ট সময়ে ঋণ সমন্বয় না করায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একক গ্রাহকের ঋণসীমা পরিপালন করা হয় নি। ব্যাংকের অনুকূলে লিয়েন করা ১১৫টি কার্যাদেশের চুক্তিমূল্য ছিলো ৭২৫ কোটি টাকা। মঞ্জুরিপত্রের শর্ত অনুযায়ী, চুক্তিমূল্যের সর্বোচ্চ ৮০ শতাংশ ঋণ বিতরণের সুযোগ থাকলেও গ্রাহককে ৮২ দশমিক ১৯ শতাংশ উত্তোলনের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। আবার ঋণের সম্পূর্ণ অংশ উত্তোলন করা হয়েছে। অনেক কার্যাদেশের চুক্তির মেয়াদ শেষের দিকে হলেও সন্তোষজনক অগ্রগতি প্রতিবেদন দেয় নি ডলি কনস্ট্রাকশন। সামগ্রিকভাবে বিল মূল্য পাওয়ার বিষয়ে অনিশ্চয়তা দেখছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কাজের অগ্রগতি অনুযায়ী ঋণ ছাড় না করা, কার্যাদেশের মেয়াদ শেষের দিকে হলেও সন্তোষজনক বিল না পাওয়া এবং গ্রাহকের ঋণ অনাদায়ী থাকায় ধারণা করা যায় গ্রাহক, শাখা কর্তৃপক্ষ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে।

শোধ না করেই যেভাবে এতো বড় ঋণ : ডলি কনস্ট্রাকশনের ২০১৫ সালের এক আবেদনে প্রথমে কার্যাদেশের বিপরীতে ৫০ কোটি টাকা এসওডি ঋণ ও ৫ কোটি টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি দেয় রূপালী ব্যাংক। পরে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে আগের ৫০ কোটি টাকা নবায়ন ও নতুন ৫০ কোটি টাকার ঋণ দেওয়া হয়। একইসঙ্গে ব্যাংক গ্যারান্টি ২৫ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। ওই বছরের আগস্টে আগের ঋণ নবায়ন করে ঋণ ২২৫ কোটি এবং ব্যাংক গ্যারান্টি ৭৫ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। ঋণ শোধ না হলেও পরের বছরের আগস্টে আবার আগের ২২৫ কোটি টাকা নবায়ন এবং নতুন ১২৫ কোটি টাকাসহ মোট ৩৫০ কোটি টাকার এসওডি সুবিধা দেওয়া হয়। আর ব্যাংক গ্যারান্টির সুবিধার পরিমাণ দ্বিগুণ করে ১২৫ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। এ দফায়ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনাপত্তির জন্য চিঠি দেয় ব্যাংক। তখন ব্যাংক কোম্পানি আইনের আলোকে একক গ্রাহকের ঋণসীমা ব্যাংকটির মূলধনের ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনার শর্তে অনাপত্তি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

পরবর্তী সময়ে ২০১৮ সালের আগস্টে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে স্মারক আকারে উপস্থাপন না করেই গ্রাহকের ঋণ বাড়ানোর প্রস্তাব করে। ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সুপারিশের আলোকে গ্রাহককে ৩৫০ কোটি টাকার ফান্ডেড ও ১২৫ কোটি টাকার নন-ফান্ডেড ঋণসীমা অনুমোদন করে পর্ষদ। ওই বছরের ডিসেম্বরে ফান্ডেড ঋণের পরিমাণ গিয়ে ঠেকে ৩৫৮ কোটি টাকায়। বিষয়টি জানার পর ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে চিঠি দিয়ে জুনের মধ্যে গ্রাহকের ঋণ নির্ধারিত সীমায় নামিয়ে আনার নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে ঋণ সমন্বয় তো দূরে থাক, ওই বছরের জানুয়ারিতে ২৫ কোটি ও মার্চে আরও ২৫ কোটি টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি সীমা ফান্ডেড ঋণে রূপান্তরের অনুমোদন দেন তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান প্রধান। পরিচালনা পর্ষদে উত্থাপন ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনাপত্তি ছাড়া এ অনুমোদনকে এমডির ক্ষমতার অপব্যবহার হিসেবে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সবমিলিয়ে সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, রূপালী ব্যাংকে গ্রাহকের ফান্ডেড ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪১১ কোটি ৬২ লাখ টাকা। ব্যাংক গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছে ৭৩ কোটি টাকা।

রূপালী ব্যাংকে নিজেদের সময়ে জালিয়াতি এবং পরে একই জালিয়াতি অব্যাহত থাকার ব্যাপারে ব্যাংকটির সাবেক এমডি এম ফরিদ উদ্দীন, আতাউর রহমান প্রধান এবং ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ- এই তিনজনকেই ফোন দেওয়া হয়। অথচ এই তিনজনের নম্বরই বন্ধ পাওয়া গেছে।