ঘূর্ণিঝড় রেমাল : ৯ জেলায় ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত

ঘূর্ণিঝড় রেমাল : ৯ জেলায় ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ : পায়রা ও মোংলা সমুদ্রবন্দরসহ উপকূলীয় ৯ জেলায় ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত দেখিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এসব জেলা হলো : খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা ও পটুয়াখালী। সমুদ্র উপকূলবর্তী এসব জায়গার কাছাকাছি দ্বীপ ও চরগুলো ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেতের আওতায় থাকবে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের সর্বশেষ ১০ নম্বর বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। 

ঘূর্ণিঝড় রেমাল নিয়ে রবিবার (২৬ মে) সকালে বিশেষ এ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরে নতুন করে ৯ নম্বর বিপৎসংকেত দেখাতে হবে।

এতে বলা হয়, ঘূর্ণিঝড় রেমাল রবিবার সকাল ৬টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৪০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৩০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৩৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ২৯৫ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থান করছিলো। এটি আরও উত্তর দিকে এগিয়ে ঘনীভূত হতে পারে। ঘূর্ণিঝড়কেন্দ্রের ৫৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৬৪ কিলোমিটার। এটি দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়ার আকারে ১৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের কাছের এলাকায় সাগর খুবই উত্তাল রয়েছে।

এই বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড় রেমাল'র প্রভাবে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং তাঁদের কাছাকাছি দ্বীপ ও চরগুলোর নিচু এলাকা স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৩ থেকে ৫ ফুটের বেশি উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে। ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবের দেশের সব বিভাগে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হতে পারে।‌

দেশজুড়ে বৃষ্টির বার্তা : ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে উপকূলের জেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে থেমে থেমে বৃষ্টি ও দমকা হাওয়া বইছে। সাগর রয়েছে উত্তাল। 

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক আজিজুর রহমান বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সারাদেশে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হতে পারে। ২৪ ঘণ্টায় ৩০০ থেকে ৩৫০ মিলিমিটার বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। চট্টগ্রাম, বরিশাল ও নোয়াখালীতে বৃষ্টি হবে বেশি। চট্টগ্রাম বা কক্সবাজার অঞ্চলে এ ধরনের বৃষ্টি হলে পাহাড়ধসের ঝুঁকি থাকবে।

উপকূলজুড়ে আতঙ্ক : আবহাওয়াবিদরা বলছেন, যেসব এলাকার ওপর দিয়ে ঘূর্ণিঝড়টি অতিক্রম করবে, সেখানে ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়তে পারে। এতে করে উপকূলজুড়ে বিরাজ করছে আতঙ্ক। ঘূর্ণিঝড়ের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে বলা হচ্ছে, প্রবল শক্তি নিয়ে রেমাল উপকূলে ছোবল হানতে পারে। এরপর সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, খুলনা, বরগুনা, পটুয়াখালী ও ভোলার দিকে ফণা তুলতে পারে। ক্ষত তৈরি করতে পারে সাতক্ষীরা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত পুরো এলাকায়। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ভারী বৃষ্টিতে পাহাড় ধসের শঙ্কাও রয়েছে। ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় সরকারের তরফ থেকে এরই মধ্যে বেশকিছু প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। 

ফ্লাইট ও নৌযান চলাচল বন্ধ : সারাদেশে লঞ্চসহ নৌযান চলাচল বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কক্সবাজারগামী আজ রবিবারের সব ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। সেই সঙ্গে রবিবার কলকাতাগামী সব ফ্লাইটও বাতিল করেছে বিমান বাংলাদেশ। রেড অ্যালার্ট-১ জারি করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। সাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার সকল নৌকা ও ট্রলারকে উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে। মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ বন্দরের নিজস্ব অ্যালার্ট থ্রি জারি করেছে। পাশাপাশি জাহাজ ও জেটিতে পণ্য ওঠানামাসহ বন্দরের সব কার্যক্রম শনিবার রাত ১০টা থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। স্থগিত করা হয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুষ্ঠেয় রবিবারের সম্মান চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা।

ঘূর্ণিঝড়ের গতিপ্রকৃতি : আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক আজিজুর রহমান বলেন, রেমাল নামটি ওমানের দেওয়া, এর অর্থ বালু। ঘূর্ণিঝড়টি সৃষ্টির পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আঘাত হানতে পারে উপকূলে। আজ রবিবার সন্ধ্যা থেকে রাত ১২টার মধ্যে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাগরদ্বীপ ও বাংলাদেশের পটুয়াখালীর খেপুপাড়ার মধ্য দিয়ে এটি ছোবল দিতে পারে। প্রবল ঘূর্ণিঝড় হিসেবে এটি স্থলভাগ অতিক্রম করলে বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ১১০ থেকে ১২০ কিলোমিটার থাকবে, যা দমকা বা ঝোড়ো হাওয়ার আকারে ১৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। সঙ্গে থাকবে বৃষ্টি ও জলোচ্ছ্বাস। ফলে যেসব এলাকার ওপর দিয়ে ঘূর্ণিঝড়টি আছড়ে পড়বে, সেখানে থাকবে একটা ধ্বংসাত্মক প্রভাব। খুলনার সুন্দরবন থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম পর্যন্ত সব উপকূলীয় জেলা এর আওতায় পড়বে। 

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে আঘাত হানা সর্বশেষ সুপার সাইক্লোন ছিল ২০০৭ সালের ‘সিডর’। এটির গতিবেগ ছিলো ঘণ্টায় ২২৩ কিলোমিটার। তখন ১৫-২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি হয়েছিলো। রেমালের গতিবেগ সম্পর্কে আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক বলেন, রেমাল এতটা শক্তিশালী নয়, এটি প্রবল ঘূর্ণিঝড়। আর প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের সময় সাধারণত তিন থেকে সাত ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়।

বিশ্বের বিভিন্ন আবহাওয়া মডেলের বরাত দিয়ে কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক পিএইচডি গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ‌ বলেন, ঘূর্ণিঝড় রেমাল তাঁর সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে বাংলাদেশের উপকূলের ছয় জেলা ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার উপকূলীয় এলাকায় আঘাত করতে পারে। রেমাল খুবই ধীরগতিতে বাংলাদেশ অতিক্রম করবে। ঘূর্ণিঝড়টির কারণে সৃষ্ট ঘূর্ণায়মান মেঘমালা মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বাংলাদেশের ওপরে থাকার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে দেশজুড়ে বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।

ছয় জেলা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ : শনিবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের এক সভায় প্রতিমন্ত্রী মহিব্বুর রহমান বলেন, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, খুলনা, বরগুনা, পটুয়াখালী ও ভোলা– এই ছয় জেলা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। সেখানে ৪ হাজার আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে। ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতির অংশ হিসেবে সভায় কয়েকটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেগুলো হলো : আগাম সতর্কতার বিজ্ঞপ্তি প্রচার ও জনগণকে সচেতন করা, আগাম মানবিক কার্যক্রম নেওয়া, মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় ও বিভিন্ন পর্যায়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটিগুলোর সভা, নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা, আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত, শুকনো খাবার, শিশুখাদ্য এবং গো-খাদ্যের ব্যবস্থা করা ও জনগণকে আশ্রয়কেন্দ্রে আনার বিষয়ে প্রস্তুতি নেওয়া। দুর্যোগ তথ্য পাওয়ার জন্য টোল ফ্রি ১০৯০ ব্যবহারের কথা সভায় জানানো হয়। 

উপকূলজুড়ে প্রস্তুতি, সতর্কতা : সভা করে দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জেলা প্রশাসন। ঝড় মোকাবিলায় কাজ করবে কোস্টগার্ড, নৌবাহিনী, রেড ক্রিসেন্টসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে খুলনা জেলা প্রশাসন। প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৬০৪টি সাইক্লোন শেল্টার, তিনটি মুজিব কিল্লা ও ৫ হাজার স্বেচ্ছাসেবক। 

খুলনার জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন জানান, এসব সাইক্লোন শেল্টারে ৩ লাখ ১৫ হাজার ১৮০ জন আশ্রয় নিতে পারবেন। আর তিনটি মুজিব কিল্লায় ৪৩০ জন আশ্রয় ও ৫৬০টি গবাদি পশু রাখা যাবে। শনিবার দুপুর ২টা থেকে চট্টগ্রামে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এ অবস্থায় চট্টগ্রাম বন্দরে নিজস্ব অ্যালার্ট-১ জারি করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক জানান, প্রাথমিকভাবে বন্দর জেটি এবং বহির্নোঙরে অবস্থানরত জাহাজগুলোকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। 

ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় ৫৪১ আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখার কথা জানিয়েছে বরিশাল জেলা প্রশাসন। পাশাপাশি জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা করাসহ নদীতীরে সতর্কবার্তা প্রচার শুরু হয়েছে। 

জেলা প্রশাসক শহিদুল ইসলাম বলেন, চাল ছাড়াও পর্যাপ্ত শুকনো খাবার মজুত রাখা হয়েছে। জেলায় নগদ বরাদ্দ হয়েছে ৫ লাখ টাকা, যা উপজেলা পর্যায়ে বণ্টন করা হয়েছে। এতে জরুরি প্রয়োজনে যে কোনও সামগ্রী কেনা যাবে। তাৎক্ষণিক মন্ত্রণালয় থেকে আরও বরাদ্দ আনা যাবে। বরগুনায় ৬৭৩টি আশ্রয়কেন্দ্র ও তিনটি মুজিব কিল্লা প্রস্তুত করা হয়েছে। এতে ৩ লাখ ২১ হাজার ২৪৪ জন আশ্রয় নিতে পারবেন।

পটুয়াখালীতে জরুরি প্রস্তুতি সভা হয়েছে। সম্ভাব্য এ ঝড় মোকাবিলায় প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৭০৩টি সাইক্লোন শেল্টার। ভোলায় উপকূলের বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে প্রচার চালাচ্ছে কোস্টগার্ড। 

বাগেরহাটে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে প্রশাসন। জেলা প্রশাসক খালিদ হোসেন বলেন, দুর্যোগের সময় নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষ যাতে নিরাপদে আশ্রয় নিতে পারেন, সেজন্য জেলায় ৩৫৯টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। রেমাল মোকাবিলায় নোয়াখালীর পাঁচ উপকূলীয় উপজেলায় ৪৬৬ আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। পাশাপাশি উপকূলে দুর্যোগকবলিত মানুষকে সহযোগিতার জন্য রেড ক্রিসেন্ট ও সিপিপি'র ৮ হাজার ৯১০ স্বেচ্ছাসেবককে প্রস্তুত রাখা হয়েছে।