‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের ওপর লুণ্ঠন চলছে।’

‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের ওপর লুণ্ঠন চলছে।’

নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলা কাগজ : জাতীয় শহিদ মিনার চত্বরের চেহারাটা মঙ্গলবার (৯ আগস্ট) ভিন্ন রকমের ছিলো। সেখানে জড়ো হয়েছিলেন দেশের নানা প্রান্তের মানুষ। বর্ণিল তাঁদের পোশাক, সেখানেও বৈচিত্র্য। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জাতিসত্তার মানুষ তাঁরা নন। তাঁরা বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ। কেউ এসেছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে, কেউ সিলেট, কেউ সমতলের উত্তরবঙ্গ থেকে। কারণ আন্তর্জাতিক উপজাতি দিবস। সেই উপলক্ষে শহিদ মিনারে সমবেত হয়েছিলেন এসব বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ।

অনেকেই বলেন, বাংলাদেশের এই যে জাতিগত বৈচিত্র্য সেটা আমাদের বড় সম্পদ। এটি আমাদের সংস্কৃতিকে পুষ্ট করেছে। কিন্তু এই বৈচিত্র্য নিয়ে আমরা কথা বলি, বাইরের দেশের মানুষদের কাছে নিজেদের তুলে ধরি- তা কি কেবল লোকদেখানো?

নাট্যজন মামুনুর রশীদ শহিদ মিনারের আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠানের উদ্বোধক ছিলেন। তিনি জোর দিয়েই বললেন, ‘আমরা যে বৈচিত্র্যের জন্য গর্ব করি, বাস্তবে তার প্রতিফলন নেই। নওগাঁর আলফ্রেড সরেন নামের এক সাঁওতাল জাতির শ্রমজীবী মানুষের হত্যার ঘটনা নিয়ে নিজের লেখা নাটকের কথা তুলে ধরলেন মামুনুর রশীদ। তিনি বললেন, এ নাটক দেশের কতো বিখ্যাত মানুষ দেখেছে। বিদেশেও অনেকে দেখেছে। কতো কথা হলো নাটক নিয়ে। কিন্তু আলফ্রেড সরেন হত্যার বিচার হলো না আজও।

ভূমিদস্যুদের হাতে ২০০২ সালের ১৮ আগস্ট আলফ্রেড সরেন নিহত হন।

মামুনুর রশীদ বলছিলেন, ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের অধিকার কি শুধু সাহিত্য আর নৃত্যগীতে থাকবে? তাঁরা কবে সুবিচার পাবেন? দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার চলছে। দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের ওপর এক ধরনের লুণ্ঠন চলছে।’

এবারের আন্তর্জাতিক উপজাতি দিবসের প্রতিপাদ্য ‘প্রথাগত জ্ঞান সংরক্ষণ ও প্রসারে উপজাতি নারী সমাজের ভূমিকা’।

করোনার কারণে টানা ২ বছর উপজাতি দিবসের প্রকাশ্য অনুষ্ঠান বন্ধ ছিলো। এবারে তাই শহিদ মিনারে উপজাতি দিবসের অনুষ্ঠান ঘিরে ছিলো উচ্ছ্বাস। সরকারি হিসাবে, দেশে মোট ৫০টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা সাড়ে ১৬ লাখের বেশি। যদিও এসব জাতির মানুষেরা দাবি করেন, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে বেশি। প্রতি বছর এ দিবসে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ একত্র হন, তাঁদের অধিকার আদায়ের কথা বলেন। এবারও তাঁরা উচ্চকিত ছিলেন অধিকারের প্রশ্নে।

সকাল ১০টায় অনুষ্ঠান শুরু হয়। শুরু থেকে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর এবং ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সংগঠনের সদস্যরা বর্ণিল পোশাক পরে মিছিল করে অনুষ্ঠানস্থলে এসে হাজির হন। অনুষ্ঠান শুরু হয় ‘মাদলে’র গান দিয়ে। এরপর চলে বক্তৃতা পর্ব।

অনুষ্ঠানের অন্যতম বক্তা ও সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘আমরা সব সময় বলেছি, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান করতে হবে। তার দিকে লক্ষ্য রেখেই ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি করা হয়েছিলো। কিন্তু পাহাড়ের নতুন করে অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টি করার চেষ্টা চলছে। সমতলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের কোথাও কোনও জায়গা নেই। সমতলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের জন্য একটি পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের কথা বলা হলেও আজ পর্যন্ত তা করা হয় নি।

অনুষ্ঠানের আরেক আলোচক, সংসদ সদস্য হাসানুল হক ইনু বলেন, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী এবং বি-গোষ্ঠী বলে সরকার প্রথমবারের মতো এ দেশে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিলো। এসব জাতিগোষ্ঠীর মানুষের এই আংশিক স্বীকৃতির এই অর্জনকে ধরে রাখতে হবে।

অনুষ্ঠানের সম্মানিত আলোচক ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নেত্রী বাসন্তী মুর্মু বলেন, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নারীরা অনেক বেশি অবহেলিত। তিনি সংসদে দুটি সংরক্ষিত আসন ওই অঞ্চলের নারীদের জন্য রাখার দাবি করেন।

সভায় আরও বক্তব্য দেন নারীনেত্রী খুশী কবির, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহিন আনাম, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ব্র্যাকের পরিচালক আন্না মিনজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেজবাহ কামাল, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি কাজল দেবনাথ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অলীক মৃ, আদিবাসী যুব পরিষদের নেত্রী চন্দ্রা ত্রিপুরা প্রমুখ।

অনুষ্ঠানে আদিবাসী দিবস উপলক্ষে জাতিসংঘের মহাসচিবের বাণী পড়ে শোনান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস।

আলোচনা পর্বের পর বিভিন্ন জাতিসত্তার সংস্কৃতিকর্মীরা গান ও নৃত্য পরিবেশন করেন।