ইসিতে ডিসি-এসপিদের হইচই, নির্বাচনকালীন ভূমিকা নিয়ে সংশয়

ইসিতে ডিসি-এসপিদের হইচই, নির্বাচনকালীন ভূমিকা নিয়ে সংশয়

ডয়চে ভেলে : ডিসি-এসপিদের হইচই ও প্রতিবাদের মুখে নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমানের বক্তব্য দিতে না পারাকে নির্বাচন কমিশন ভুল বোঝাবুঝি বলে মনে করে। তবে সাবেক এক নির্বাচন কমিশনার ও এক বিশ্লেষকের মত, এতে আইন ও সংবিধানের লঙ্ঘন হয়েছে।

দায়িত্ব নেওয়ার পর শনিবার প্রথমবারের মতো মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনের সঙ্গে ঢাকায় মতবিনিময় করে নতুন নির্বাচন কশিমন। এই সভায় দেশের সব জেলার জেলা প্রশাসক (ডিসি) এবং পুলিশ সুপাররা (এসপি) উপস্থিত ছিলেন। নির্বাচনে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন এবং নির্বাচন কমিশনের চাহিদা মতো কাজ করার বার্তা দিতেই এই বৈঠকের আয়োজন করা হয়।

জানা গেছে, মত বিনিময় সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে জনমনে আস্থাহীনতার জন্য ডিসি-এসপিদের ওপর দায় চাপান। তিনি জেলা পরিষদ নির্বাচনে স্থানীয় এমপিদের তরফে আচরণবিধি লঙ্ঘনের কথা তুলে ধরেন। কোনো কোনো এমপি ইসি সদস্যদের প্রকাশ্যে গালি দিচ্ছেন বলেও জানান।

কমিশনারকে বক্তব্য দিতে বাধা : ইসির পক্ষ থেকে আয়োজিত রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন অংশীজনদের নিয়ে ধারাবাহিক এই সংলাপে শনিবার বক্তব্য দিতে গিয়ে ডিসিদের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন আনিছুর রহমান। মাঠ প্রশাসনের কর্তাদের ‘নখদন্তহীন' এবং তারা ‘মন্ত্রী-এমপিদের ছাড়া চলতে পারেন না’ বলে মন্তব্য করেন তিনি। ম্যাজিষ্ট্রেটদের জন্য বরাদ্দ গাড়ির জন্য তেলের টাকাও ডিসিরা দেন না বলে উল্লেখ করেন তিনি।

তার বক্তব্যের এই পর্যায়ে সভাকক্ষের মধ্যেই একযোগে ডিসি-এসপিরা হইচই শুরু করেন। এ সময় সিইসিসহ অন্য কমিশনার এবং জননিরাপত্তা বিভাগের সচিবও মঞ্চে ছিলেন। এ পর্যায়ে কমিশনার আনিছুর রহমান বলেন, ‘‘তাহলে কি আপনারা আমার বক্তব্য শুনতে চান না।’’ তখন সবাই একযোগে ‘না' বললে নিজের বক্তব্য শেষ না করেই বসে পড়েন তিনি। আনিছুর রহমান সবশেষ জ্বালানি সচিব হিসেবে অবসরে যান।

এই বিষয়ে বক্তব্য জানতে আনিছুর রহমানের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায় নি।

নির্বাচন কমিশন ও ডিসিরা যা বলছেন : সভায় উপস্থিত দুই জন ডিসির সঙ্গে কথা বললে তারা দাবি করেন, নির্বাচন কমিশনার আপত্তিকর শব্দ ব্যবহার করেছেন, যা প্রকাশ করার মতো না। ফলে এর প্রতিবাদ জানানো হয়। এক পর্যায়ে তিনি যখন প্রশ্ন করেন যে, ‘আপনারা কি আমার বক্তব্য শুনতে চান না?' তখন সবাই না বললে তিনি বক্তৃতা শেষ না করেই বসে পড়েন। পরে আর এটা নিয়ে কেউ কোনো কথা বলেননি। এই দুই জেলা প্রশাসকের কেউ নাম প্রকাশ করতে রাজি হন নি।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশন রাশিদা সুলতানা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এটা এমন কিছু না। এটা সামান্য একটু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। উনি বলাটাও দোষের হয় নাই। ...ওরা একটু রিয়্যাক্ট করেছে। এর বেশি কিছু না। এটার জন্য আমরা উদ্বিগ্ন না। এটা একটা অনাকাঙ্খিত ঘটনা হয়ে গেছে। নানা কারণে সেটা হতে পারে।''

প্রশাসনের কর্মকর্তারা তাদের আচরণের জন্য পরে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘...ওটা ওখানেই শেষ, আমরা কেউ কিছু মনে রাখিনি। ওনারাও একবাক্যে সবাই বলেছেন, আপনারা যেভাবে নির্দেশনা দিবেন আমরা সেভাবেই কাজ করব।''

মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করবে বলে আস্থা রাখছে ইসি। অন্যথায় আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে বলে জানান রাশিদা সুলতানা। তিনি বলেন, ‘‘যেখানে যেখানে নির্বাচন হচ্ছে সেখানে নির্বাচনকালীন সময়ে তারা ইসির অধীনে। এক্ষেত্রে কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। কোনো ব্যাত্যয় হলে ছাড় দেয়া হবে না বলে জানানো  হয়েছে।''

আইনের লঙ্ঘন? : তবে সাবেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম মনে করেন, জেলা প্রশাসকরা যা করেছেন তা সংবিধান ও আইনের লঙ্ঘন। হইচই করে একজন নির্বাচন কমিশনকে বক্তব্য দিতে না দেয়া সরকারি কর্মচারি আচরণবিধর লঙ্ঘন বলেও মত তার। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘কমিশনের আদেশ নির্দেশ ওনারা শুনতে বাধ্য। নির্দেশ আইন সঙ্গত না হলে তারা তাদের উপরের কর্তৃপক্ষকে জানাবে। তখন সেখান থেকে ব্যবস্থা নেয়া হবে।''

কিন্তু সেটি না করে সাংবিধানিক সংস্থার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মকর্তাদের এমন আচরণে উদ্বেগ প্রকাশ করেন সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার। নির্বাচনকালীন সময়ে কর্মকর্তারা ইসির নির্দেশ অনুযায়ী আদৌ দায়িত্ব পালন করবেন কিনা এই ঘটনায় তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন তিনি। বলেন, ‘‘ ওনারা যে আচরণ করলেন তাতে তো ওনারা বাধ্য নন। তারা শুধু প্রতিবাদ করেই পিছপা হননি বরং কমিশনকেই পিছনে চলে যেতে বাধ্য করেছেন।’’

এই বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন ছিল বলে উল্লেখ করেন তিনি। বলেন, ‘‘আমি হলে এটা মন্ত্রিপরিষদ সচিব, জনপ্রশাসন সচিব, জন নিরাপত্তা সচিবকে জানাতাম। তাদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান এবং ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে তার ব্যবস্থা নিতাম।’’

তবে তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন ছাড়া কর্মকর্তাদের উদ্দেশে আনিছুর রহমানের ঠালাওভাবে মন্তব্য করা ঠিক হয়নি বলেও মনে করেন সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার।   

‘ডিসি-এসপিরা নির্বাচনকে নিয়ন্ত্রণ করবে’ : সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের মতে, ২০১৮ সালের নির্বাচনেই ডিসি-এসপিদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। ‘তারা রাতের ভোটে সহায়তা করেছে' এমন মন্তব্য করেন তিনি। ডয়চে তিনি বলেন, "সমস্যা তো নির্বাচন কমিশনে। তারাইতো নিরপেক্ষ না। তারা যদি নিরপেক্ষ হতো তাহলে এ ধরনের আচরণ করতে সাহস পেত না। তাদের বিরুদ্ধে এই ঘটনার পর ব্যবস্থা নেয়া হতো।”

তিনি বলেন, ‘‘এভাবে চলতে থাকলে সামনের নির্বাচনে ডিসি-এসপিরা আরো বেশি প্রভাব বিস্তার করবে। তারাই নির্বাচনকে নিয়ন্ত্রণ করবে।”

প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের বাংলা সংস্করণ। এই প্রতিবেদনের সব ধরনের দায়ভার ডয়চে ভেলের।