ইকবালের ভিডিওতে সিসি ক্যামেরা ঘুরলো যে কারণে

ডন প্রতিবেদন : কুমিল্লার নানুয়ার দিঘির পাড়ের পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরিফ রাখায় প্রধান সন্দেহভাজন হিসেবে শনাক্ত ইকবাল হোসেন কোরআনটি নিয়েছিলেন মণ্ডপের পাশের এক মাজারের মসজিদ থেকে। মণ্ডপে সহিংসতার আগের রাতে তিনি কোরআন শরিফটি হাতে নিয়ে মণ্ডপের দিকে রওনা হন। এরপর মূল মণ্ডপের বাইরে পূজার থিম হিসেবে রাখা হনুমানের মূর্তির ওপর কোরআন রেখে ফিরে আসেন ইকবাল। এসব দৃশ্য ধরা পড়েছে ওই এলাকার সিসিটিভি ক্যামেরায়। তবে মসজিদ থেকে কোরআন হাতে ইকবালের বেরিয়ে যাওয়ার সিসিটিভি ফুটেজ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে আলোচনার ঝড়। ফুটেজে কখনও জুম ইন, নড়াচড়া, ঝকঝকে ছবি এবং ক্যামেরা প্যান (ঘোরানো) নিয়ে প্রশ্ন তুলে এর সত্যতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন অনেকে। এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সিসিটিভি ক্যামেরার আমদানিকারক, ভিডিও ফুটেজ বিশেষজ্ঞ, তদন্ত কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছে বাংলা কাগজ এবং আওয়ার ডন। মসজিদের দৃশ্য ধরা পড়েছে যেসব ক্যামেরায় তার মালিকের বক্তব্যও নেয়া হয়েছে। এতে পরিষ্কার হয়েছে, এভাবে ফুটেজ পাওয়ার কারণ। ইকবালের ভিডিওতে সিসিক্যাম ঘুরলো যে কারণে : প্রধান অভিযুক্ত ইকবাল হোসেন মাজারের মসজিদ থেকে কোরআন শরিফ নিয়ে রওনা হন মণ্ডপের দিকে। এর সিসিটিভি ফুটেজ নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা। আমাদের হাতে আসা কয়েকটি সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রধান অভিযুক্ত ইকবাল সহিংসতার আগের রাতে একটি মাজারের মসজিদ থেকে কোরআন শরিফটি নিয়ে মণ্ডপের দিকে রওনা হন। সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে সময়টি তখন রাত ২টা ১০ মিনিট। নানুয়ার দিঘির পাশেই শাহ আবদুল্লাহ গাজীপুরি (রা.)-এর মাজারটির অবস্থান। মণ্ডপ থেকে হেঁটে যেতে সময় লাগে ২ থেকে ৩ মিনিট। দারোগাবাড়ী মাজার নামে কুমিল্লাবাসীর কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিতি রয়েছে মাজারটির। এর মসজিদের বারান্দায় তিলাওয়াতের জন্য রাখা থাকে বেশ কয়েকটি কোরআন শরিফ। রাত-দিন যেকোনো সময় যে কেউ এখানে এসে তিলাওয়াত করতে পারেন। মাছ পাহারার সিসিটিভি ক্যামেরায় চিহ্নিত ইকবাল : আমাদের অনুসন্ধানে জানা গেছে, মসজিদ থেকে ইকবালের কোরআন শরিফ নেয়ার দৃশ্যটি ধরা পড়ে মাজারের পুকুরের পূর্বপাড়ের একটি বাসার সিসিটিভি ক্যামেরায়। ‘আশার আলো’ নামের ওই বাড়ির মালিক সাইদুর রহমান। তিনি কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার সোনালী ব্যাংক শাখার প্রিন্সিপাল অফিসার। বর্তমানে ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করছেন। সাইদুর বাংলা কাগজ এবং আওয়ার ডনকে জানান, তিন বছর আগে আড়াই লাখ টাকায় দারোগাবাড়ী মসজিদের সামনের পুকুরটি ইজারা নেন। শখের বসে এই পুকুরে তিনি মাছ চাষ করেন। পুকুর থেকে মাছ চুরি ঠেকাতে তিন তলা বাড়িটির বাইরের দিকের দোতলায় উন্নত প্রযুক্তির একটি সিসিটিভি ক্যামেরা বসিয়েছেন সাইদুর। ৩৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলের এই ক্যামেরাটি প্রতি চার মিনিট অন্তর মুভ করে। মূল ক্যামেরার আশপাশে আরও চারটি ফিক্সড ক্যামেরা রয়েছে। সাইদুর বাংলা কাগজ এবং আওয়ার ডনকে জানান, তিনি মোট ৮০ হাজার টাকায় পাঁচটি সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করেন। তদন্তের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসব ক্যামেরার ডিভিআর বক্স (যেখানে ফুটেজ সংরক্ষণ হয়) নিয়ে গেছে। ইকবালের কোরআন নেওয়ার দৃশ্য সাইদুরের বাড়ির বেশ কয়েকটি সিসিটিভি ক্যামেরায় ধরা পড়েছে। এর মধ্যে আলোচিত ফুটেজটি সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ইউএনভি ক্যামেরার। মাজারের পুকুর ইজারা নেয়ার পর মাছ পাহারায় কয়েকটি সিসিটিভি বসেছে ‘আশার আলো’ নামের বাড়িটিতে : বাংলা কাগজ এবং আওয়ার ডন পরীক্ষা করে দেখেছে, ইউএনভি পিটিজেড প্রাইম ক্যাটাগরির IPC6222ER-X30-B মডেলের ক্যামেরাটি বসানো হয়েছে সাইদুরের বাড়িতে। গ্লোবাল ইউনিভিউ ডটকম নামের একটি ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা গেছে, এ ধরনের সিসিটিভি ক্যামেরা সাধারণ ক্যামেরার চেয়ে ৩০ গুণ অপটিক্যাল জুম করে অবজেক্টের ছবি নিতে সক্ষম। অপটিক্যাল জুমের কারণে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরের বস্তুর ছবিও পরিষ্কারভাবে ধারণ করা সম্ভব। এ ছাড়া সিএমওএস সেন্সর থাকায় এটি দূরের চলমান বস্তুকে চিহ্নিত করে এর হাই রেজ্যুলিউশনের ছবি তুলতে সক্ষম। সাইদুর রহমান এই ক্যামেরাটি কেনেন কুমিল্লা নগরীর মনোহরপুরের পিসি নেট কম্পিউটার্স থেকে। দোকানের মালিক জহিরুল ইসলাম বাংলা কাগজ এবং আওয়ার ডনকে জানান, ইউএনভি পিটিজেড প্রাইম ক্যাটাগরির IPC6222ER-X30-B মডেলের ক্যামেরা তারা ৪৫ হাজার টাকায় বিক্রি করছেন। এটি সর্বাধুনিক নিরাপত্তা প্রযুক্তিসম্পন্ন সিসিটিভি ক্যামেরা। হাই রেজ্যুলেশনের এ ক্যামেরায় ভিডিওর পাশাপাশি অডিও ধারণও সম্ভব। আধুনিক সিসিটিভি ক্যামেরা নিয়ে যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা : প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও সিসিটিভি আমদানিকারকেরা বলছেন, বাজারে এখন অত্যাধুনিক প্রযুক্তির অনেক ধরনের সিসিটিভি ক্যামেরা পাওয়া যায়। এক হাজার টাকা থেকে লাখ টাকার ক্যামেরাও আছে। চাহিদা বিবেচনায় প্রতিনিয়তই এসব ক্যামেরায় নতুন নতুন ফিচার যুক্ত করছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। বাংলাদেশে সিটিটিভি ক্যামেরা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এক্সেল টেকনোলজির সিসিটিভি ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তা রাজিব বিশ্বাস বাংলা কাগজ এবং আওয়ার ডনকে বলেন, ‘এখন মানুষ নিরাপত্তার জন্য অনেক ইনভেস্ট করে। তাদের চাহিদা অনুযায়ী প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সিসিটিভি ক্যামেরা বাজারে আসছে। এখন ক্যামেরা দিয়ে শুধু ভিডিও ধারণ করা যায় তাই নয়, শব্দ রেকর্ড করাসহ কথাও বলা যায়।’ তিনি বলেন, ‘ভালো ক্যামেরায় প্রায় ১ কিলোমিটার পর্যন্ত দূরের ফুটেজ ধারণ করা যায়। এখনকার প্রায় সব ক্যামেরার ফুটেজ জুম করেও দেখা যায়। অপটিক্যাল জুম ও ডিজিটাল জুম নামে দুটি অপশন রয়েছে। অপটিক্যাল জুম করে অনেক দূরের ছবি ফুটেজ জুম করলেও তা স্পষ্ট দেখা যায়, এতে রেজ্যুলেশনের খুব একটা পরিবর্তন ঘটে না।’ ইউএনভি পিটিজেড প্রাইম ক্যাটাগরির IPC6222ER-X30-B মডেলের ক্যামেরার স্পেসিফিকেশন : ৩৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেল ক্যামেরা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এগুলোকে পিটিজেড (প্যান, টিল, জুম) ক্যামেরা বলা হয়। এই ক্যামেরা চারপাশে ৩৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেল পর্যন্ত ভিডিও ধারণ করতে পারে। অর্থাৎ একটি নিদিষ্ট অ্যাঙ্গেলে কোনো ভিডিও ধারণ করা হলে এর ডান, বাম, ওপর, নিচ সব জায়গায় ৩৬০ ডিগ্রি সীমানা পর্যন্ত ছবি বা ভিডিও দেখা য়ায়। শুধু তাই নয়, ওই ক্যামেরায় ট্র্যাকিং সেন্সর থাকলে কোনো কিছুর মুভমেন্টও অটোমেটিক ধারণ করা যায়। অর্থাৎ এই প্রযুক্তির ক্যামেরার সামনে দিয়ে কিছু নড়াচড়া করলে বা কেউ হেঁটে গেলে ক্যামেরা তাকে অনুসরণ করে নিজে নিজে ঘুরবে।’ ইকবালের আলোচিত ফুটেজটি নিয়ে ভিডিও সম্পাদনা বিশেষজ্ঞদের মতামতও নিয়েছে বাংলা কাগজ এবং আওয়ার ডন। ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের সিনিয়র ভিডিও এডিটর রিফাত আনোয়ার লোপা বাংলা কাগজ এবং আওয়ার ডনকে বলেন, ‘আমি সিসিটিভি ফুটেজটি দেখেছি। সিসিটিভির আধুনিক ফর্ম হিসেবে, বেশি জায়গাজুড়ে দেখার জন্য ফিশআই ক্যামেরা (ফিক্সড ক্যামেরা) ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া, ডোম ক্যামেরাও (মুভিং ক্যামেরা) আছে। দীর্ঘদিনের এডিটিং অভিজ্ঞতায় আমার মনে হয়েছে, এটা ডোম ক্যামেরার ফুটেজ।’ ইকবালের ফুটেজটি নিয়ে যা বলছেন তদন্তকারীরা : কুমিল্লার নানুয়ার দিঘির পাড়ের পূজামণ্ডপে কোনো সিসিটিভি না থাকলেও আশপাশের অনেক প্রতিষ্ঠান ও বাসায় সিসিটিভি রয়েছে। ওই মণ্ডপে ১৩ অক্টোবরের সহিংসতার পর তদন্তে নেমে আশপাশের সব ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে পুলিশ। এসব ফুটেজে কোরআন রাখার আগে-পরে ইকবাল কোন পথে আসা-যাওয়া করেছেন তাও ধরা পড়েছে। পুলিশ বলছে, তদন্তের স্বার্থে সব সিসিটিভি ফুটেজ ফরেনসিক বিভাগে এনে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এতেই ইকবালের অপরাধের প্রমাণ ধরা পড়ে। এরপর যেসব ফুটেজে ইকবালকে দেখা গেছে, সেগুলো ঘটনার ক্রম অনুযায়ী সংরক্ষণ করেছে পুলিশের ফরেনসিক টিম। আলোচিত ফুটেজটি পুলিশের সাইবার ফরেনসিক কম্পিউটারের মনিটর থেকে মোবাইল ফোনে ধারণ করা। ইকবালের গতিবিধির সব ফুটেজ একসঙ্গে কম্পিউটারে চালিয়ে তা পর্যালোচনা করছিলেন কয়েকজন কর্মকর্তা। এ সময় একজন মনিটর থেকে মোবাইল ফোনে ফুটেজটি ধারণ করেন। এক কর্মকর্তা বাংলা কাগজ এবং আওয়ার ডনকে বলেন, ‘প্রকাশ পাওয়া ফুটেজটি ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এর চারপাশে কম্পিউটার মনিটরের কালো বর্ডার দেখা যাচ্ছে। আর স্ক্রিনের নিচের দিকে ভিডিও প্লেয়ার সফটওয়্যারের মেন্যু দৃশ্যমান। ফরেনসিক ল্যাবে ফুটেজটি বিশ্লেষণের সময় এটি জুম করে প্লে করা হয়েছিল, যাতে ইকবালের গতিবিধি স্পষ্ট ধরা পড়ে। উচ্চপ্রযুক্তির সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজের কারণেই এভাবে জুম করা সম্ভব হয়েছে।’ তিনি জানান, ৩৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেল পজিশনের ধারণ করা ফুটেজটি ফরেনসিক ল্যাবের কম্পিউটারে ইচ্ছেমতো জুম ইন ও জুম আউট করে নানা অ্যাঙ্গেল থেকে যাচাই করা হচ্ছিল। এ সময়েই একজন মোবাইল ফোনে সেটি ধারণ করেন। এই ফুটেজের বিষয়ে জানতে চাইলে কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এম তানভীর আহমেদ বাংলা কাগজ এবং আওয়ার ডনকে বলেন, ‘কুমিল্লার ঘটনাটির পিছনে কারা দায়ী তা জানতে আমরা সবকিছু নিখুঁতভাবে মনিটর করছি। ঘটনার আগের রাতে কুমিল্লা শহরে যতগুলো সিসিটিভি ক্যামেরায় ইকবালকে দেখা গেছে, সব আমরা সংগ্রহ করেছি। আমরা সব ক্যামেরার পুরো হার্ডড্রাইভ নিয়ে এসেছি, যাতে কেউ কোনো ফুটেজ ডিলিট করে দিলেও আমরা উদ্ধার করতে পারি। ‘আমাদের এক্সপার্ট ফরেনসিক টিম সিসিটিভি ফুটেজগুলো নিয়ে কাজ করেছে। এই ফুটেজ আমাদের ফরেনসিক ল্যাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ৩৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলের ক্যামেরার ফুটেজ হওয়ায় সেটি জুম করে দেখা যায় এবং পজিশনও পরিবর্তন করা যায়। এখানে ভিডিও এডিট করার কোনো কারণ নেই।’