অগ্রণীর শামস্‌-উলের বিপুল জালিয়াতি

অগ্রণীর শামস্‌-উলের বিপুল জালিয়াতি

নিজস্ব প্রতিবেদক, বাঙলার কাগজ; রাহাতুল রাফি : বিপুল পরিমাণে জালিয়াতি করেছেন অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ শামস্‌-উল ইসলাম। এরই অংশ হিসেবে শুধু একটি তদন্তেই বেরিয়ে এসেছে ২৬টি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া ঋণে অনিয়ম। যেগুলো ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই কম।   তিনি করেছেন পেনশনের টাকা নিয়ে অনিয়ম। শামস্‌-উলের বিরুদ্ধে অভিযোগ, বিভিন্ন কেনাকাটা থেকে শুরু করে নানা প্রক্রিয়ায় তিনি অগ্রণী ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। অবৈধ উপায়ে উপার্জিত অর্থ তিনি নামে-বেনামে দেশে বিনিয়োগ করার পাশাপাশি বিদেশে পাচার করেছেন। এর একটি অংশ কানাডা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গেছে বলেই জানা গেছে।

অভিযোগের ব্যাপারে জানার জন্য রোববার (১৬ এপ্রিল) অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শামস্‌-উল ইসলামকে ফোন দেওয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেন নি। 

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, মোহাম্মদ শামস্‌-উলের আমলে ২৬টি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া ঋণ ইতোমধ্যেই মন্দ ঋণে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ এসব ঋণের অর্থ ফিরে আসার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।

জানা গেছে, অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস্‌-উল ইসলাম বরাবর পাঠানো দুদকের (দুর্নীতি দমন কমিশন) চিঠিতে যেসব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত, বিভিন্ন সময়ে দেওয়া ঋণের পরিমাণ, ঋণের শর্ত ও ঋণের বর্তমান পরিস্থিতি, বাংলাদেশ কর্তৃক অডিট আপত্তিসহ অনিয়ম এবং দুর্নীতি সংশ্লিষ্ট নথিপত্র তলব করা হয়।

দুদক জানায়, প্রথমে বেশ কয়েকবার তাগাদা দেওয়ার পরও নথিপত্র দুদককে দেয় নি অগ্রণী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। পরে কিছু কাগজ দেওয়া হয়। এরপর অন্যান্য কাগজগুলো দেওয়া হয়।

এ ব্যাপারে দুদকের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অগ্রণীর সাবেক এমডির জোর ছিলো কোথায়?

কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সেন্ট্রাল অ্যাকাউন্টস ডিভিশনে পেনশনের টাকা নিয়ে অনিয়ম করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ৩০২ কোটি টাকা বিল হিসেবে উপস্থাপনে ব্যর্থ হয়েছে ব্যাংকটি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অগ্রণী ব্যাংকের রমনা করপোরেট শাখার ৩ গ্রাহক প্রতিষ্ঠান ঋণের নামে নিয়ে গেছে প্রায় ৫২ কোটি টাকা। এগুলো হলো : আহমেদ স্পিনিং মিলসের অনুকূলে ৩০ কোটি টাকা, রবি ফ্যাশনের অনুকূলে প্রায় ৬ কোটি টাকা এবং মেসার্স হেলেনা এন্টারপ্রাইজের অনুকূলে ১৬ কোটি টাকা। একইভাবে আমিন কোর্ট করপোরেট শাখার ৪ গ্রাহক প্রতিষ্ঠান ঋণের নামে নিয়ে গেছে প্রায় সাড়ে ৫৪ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো : মেসার্স প্যান্ডোরা ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের অনুকূলে ৬ কোটি টাকা, মেসার্স বেস্ট ট্রেড লিংকের অনুকূলে সাড়ে ২৪ কোটি টাকা, মেসার্স রেদোয়ান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের অনুকূলে ১৪ কোটি টাকা এবং ইউনি অ্যালায়েন্স জুট ইন্ডাস্ট্রিজের অনুকূলে ১০ কোটি টাকা। এসব ঋণের পুরোটাই আদায় অনিশ্চিত হয়ে মন্দ খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে আরও জানা গেছে, গত পাঁচ বছরে অগ্রণী ব্যাংকের আমানত, বিতরণকৃত ঋণসহ ব্যবসায়িক পরিধিও প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু এ সময়ে ব্যাংকটির আর্থিক স্বাস্থ্য সুদৃঢ় না হয়ে আরও ভঙ্গুর হয়েছে। ২০২১ সালে সুদ খাতে ব্যাংকটি লোকসান দিয়েছে ৭৪৪ কোটি টাকা। এ সময়ে অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৪ হাজার ২৩৫ কোটি টাকা বেড়েছে। ২০২১ সাল শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৯ হাজার ৯৯২ কোটি টাকায়, যা মোট ঋণের ১৬ দশমিক ৭১ শতাংশ। খেলাপি ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত সঞ্চিতিও রাখতে পারে নি অগ্রণী ব্যাংক। ২০২১ সাল শেষে ৪ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা সঞ্চিতি ঘাটতি ছিলো ব্যাংকটির। আলোচিত সময়ে ব্যাংকটির এমডির দায়িত্বে ছিলেন মোহাম্মদ শামস্‌-উল ইসলাম।

উল্লেখ করা যেতে পারে, শ্রেণিকৃত বিভিন্ন ঋণের বিপরীতে ঝুঁকি অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। যাতে কোনও কারণে টাকা ফেরত না এলেও ওই টাকা থেকে গ্রাহক তথা আমানতকারীর টাকা দেওয়া যায়। এক্ষেত্রে সঠিক পরিমাণে প্রভিশনও সংরক্ষণ করে নি অগ্রণী ব্যাংক। ফলে সৃষ্টি হয়েছে আমানতকারীদের ঝুঁকি।

সূত্রমতে, অগ্রণী ব্যাংকের এমডি বড় গ্রাহকদের ঋণ দেওয়ার বিপরীতে বড় অংকের কমিশন গ্রহণসহ বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেছেন বলে দুদকের কাছে অভিযোগ রয়েছে। 

এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন কেনাকাটা থেকে শুরু করে নানা প্রক্রিয়ায় অগ্রণী ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। অবৈধ উপায়ে উপার্জিত অর্থ তিনি নামে-বেনামে দেশে বিনিয়োগ করার পাশাপাশি বিদেশে পাচার করেছেন। এর একটি অংশ কানাডা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গিয়েছে বলেই অভিযোগ পেয়েছে দুদক। আর এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত করছে সংস্থাটি।