বিশ্ব যুব দক্ষতা দিবস
নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ : ফেসবুক স্ক্রল করতে গিয়ে কখনও এমন হয়েছে, একটা চায়ের কাপ, একটা ল্যাপটপ, পাশে চশমা কিংবা ফাইল- এ জাতীয় ছবিতে কি চোখ আটকে গিয়েছে? ছবি দেখে বোঝাই যাচ্ছে, কেউ হয়তো অফিসে থেকেই একটু কর্মবিরতি নিয়েছে। যে বিরতিতে কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়ের একটা ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করেছে। কেউ আরেকটু অ্যাস্থেটিক। ডেস্ক যদি জানালার পাশে হয় আর একটা কদম বা কৃষ্ণচূড়ার গাছ যদি জানালা ঘেষে থাকে, তবে তো কথাই নেই। আবেগ ষোলআনা। খুব সাদামাটা এ ছবিগুলো কারও কাছে কর্মের বিরতি হলেও কারও কাছে দীর্ঘশ্বাস আর আফসোসের। অফিসে থেকে এমন ছবি যদি সে-ও তুলতে পারতো! একটা চাকরি যদি তারও থাকতো!
অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে কাজের সুযোগ না পাওয়া, পছন্দের চাকরি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার কষ্ট সে বুঝবে যার এসবের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। তার উপর আমাদের অর্জিত শিক্ষা, আমাদের কর্ম নিয়োগের স্থান, সবটা মিলিয়েই আমাদের তরুণরা অনেক ধরণের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে প্রতিনিয়তই। ধরুন কেউ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছে। আমরা আশা করবো আমাদের দেশ আরেকজন দক্ষ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার পেতে যাচ্ছে। কিন্তু সে হয়তো গ্র্যাজুয়েশনের পর ব্যাংকে পরীক্ষা দিয়ে একজন ব্যাংকার হয়ে গেলো! এমন উদাহরণ কিন্তু অসংখ্য।
কোনও কাজ করছে না, প্রশিক্ষণও নিচ্ছে না, আবার শিক্ষার্থীও নয়, এমন যুবকদের বলা হচ্ছে NEET। অর্থাৎ Not in Education, Employment, or Training। আর এই NEET দলে তালিকাভুক্ত আছে বিশ্বের প্রায় ২৬৭ মিলিয়ন যুবক। ধারণা করা হচ্ছে খুব শীঘ্রই হয়তো সংখ্যাটা ২৭৩ মিলিয়ন এর ঘর ছোঁবে। নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান থেকে চারপাশে তাকালে আমরা খুব বুঝতে পারি, আমাদের দেশে অনেক কাজ আছে। কিন্তু সেই কাজে যোগ দেওয়ার মানসিকতা সম্পন্ন মানুষ নেই। যে কারণে কেউ কর্মজীবন নিয়ে হতাশ, আবার কেউ কর্মজীবন না পেয়ে হতাশ।
যদি জিজ্ঞাসা করি, এই মূহুর্তে বাংলাদেশে কোন সমস্যাটি সবচেয়ে প্রকট। অবিলম্বে উত্তর আসবে- বেকারত্ব। চাকরি নেই। টাকা নেই। তার উপর কোম্পানিগুলোও ভুড়ি ভুড়ি অভিজ্ঞতা চেয়ে বসে থাকে। যে যুগটায় আমরা আছি, এখানে কাউকে বসিয়ে রেখে কাজ শিখিয়ে দক্ষ করে তোলাটা কঠিন। আমাদের মধ্যে অনেকে আঙ্গুল তোলেন নিয়োগকর্তাদের উপর, কেন তারা নিয়মে শিথিলতা আনেন না। এ তাদের অন্যায় না অনিয়ম, তা বলা মুশকিল কিন্তু আপনার বাসায় যে মেয়েটা কাজ করে দেয়, তাকেও কিন্তু আপনি রেখেছেন কাজ জানে বলেই! কাজ না জানলে আপনিও তাকে রাখতেন না।
অভিজ্ঞতা বাড়ে দক্ষতায়। যা শেখার আগ্রহ, জানার আগ্রহ অনেকেরই নেই। আমাদের সমস্যা এখানেই শেষ না। প্রায় সবাই একই ঘরানার কাজ করতে চায়। আজ হয়তো কেউ জানলো, মোবাইলে লিখে আয় করা যায়। ব্যস শতশত মানুষ এগিয়ে আসবে আয় করতে। কিন্তু কাজ শেখার বেলায়? আমাদের সবচেয়ে বড়ো ব্যর্থতা হয়ত এখানেই যে, আমাদের অনেকে আয় করতে চায় কিন্তু কাজ শিখতে চায় না। স্মার্ট স্যালারি, আসা-যাওয়ার জন্য অফিসের গাড়ি, আলাদা ডেস্ক, নিজের এসি কেবিন, হেলেদুলে বসার মতো চেয়ার, এক হুকুমে দশ জন ওঠা-বসার ব্যাপারটা কিন্তু শুরুতেই আসে না। এগুলো অর্জন নিতে হয়। নিজের ভেতর রাখতে হয় দক্ষতার মিশেলে সুদৃঢ় নেতৃত্বের।
২০১৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ১৫ জুলাইকে বিশ্ব যুব দক্ষতা দিবস হিসাবে ঘোষণা করার বিষয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। ঠিক তার পরের বছর, ২০১৫ সালে প্রথম বারের মতো পালিত হয় বিশ্ব যুব দক্ষতা দিবস। শনিবার সেই ১৫ই জুলাই। World Youth Skills Day অর্থাৎ বিশ্ব যুব দক্ষতা দিবস। প্রতি বছর এই দিনে নিউ ইয়র্ক সিটি এবং জাতিসংঘের সদর দপ্তরে যুবকদের দক্ষতা বিষয়ে প্রশিক্ষণের গুরুত্ব বোঝাতে নানান ইভেন্টের আয়োজন করা হয়। তার মানে আপনি বুঝতে পারছেন, দক্ষতা বিষয়টা আসলেই ছেলের হাতের মোয়া নয়। নিউইয়র্কের মতো দেশ, যেখানে যেতে পারাটাই অনেকের জন্য স্বপ্নের, সেখানে দক্ষতা অর্জনের জন্য বলা হয়। মনে প্রশ্ন আসে না, কেন এত উন্নত শহরে দক্ষতার প্রয়োজন? যে মানুষ যত দক্ষ, সে মানুষটা তার চারপাশের মানুষ থেকে তত উন্নত। এ আপনি জানেন? এবার হিসাবটা শহর, দেশ কিংবা জাতির ক্ষেত্রে মিলিয়ে নিন।
আমাদের দেশে মানসিকতার একটা ভারসাম্যহীনতা খুব দেখা যায়। অনেক যুবকদের মধ্যে দক্ষতা অর্জনের কোন ইচ্ছা কিংবা আগ্রহ দেখা যায় না। অনেকের চাকরি না হওয়ার বড়ো কারণ দক্ষতার অভাব। ভালো অবস্থানের চাকরি, মোটা টাকার বেতন আশা করেন এমন অনেকে থাকলেও দক্ষ হওয়ার ব্যাপারে কেন যেন আর কথা বাড়াতেই চান না। তাদের ব্যাপারটা এমন- ‘কাজে ঢুকলেই দক্ষ হয়ে যাবো’। বিষয়টাকে এভাবেও বোঝানো যায়- ‘পরীক্ষার হলে প্রশ্ন দেখলেই সব মনে পড়বে, আগে পড়ে কী হবে?’ অথচ আমাদের নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা যেটাতেই আপনি আগাতে চান না কেন, সেটা নিয়ে সামান্য ঘাটাঘাটি করলেই টের পাওয়া যায় দক্ষতা কেবল কাজে যোগদানের জন্য নয় বরং দক্ষ হয়েই কাজে এগোতে হবে। আর এই দিনটি পালনের উদ্দেশ্য এটাই।
দক্ষ হওয়া যে খুব জরুরি তা কিন্তু কয়েকটা ইন্টারভিউ বোর্ড ঘুরে এলে কিংবা চাকরির রিকোয়ার্মেন্টস দেখলেই বোঝা যায়। আমরা যা অভিজ্ঞতা বলে চালিয়ে দেই, আদতে তা দক্ষতা। যা আপনার মনোভাব পালটে দেবে। একা হাতে কাজ করার একটা আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হবে নিজের মধ্যে, তবে এটা অহংবোধ নয়। একইসঙ্গে অনুপ্রেরণার জন্য আপনাকে অন্যের দ্বারস্থ হতে হবে না। সার্বিকভাবেই একটা ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করবে আপনার মন ও মস্তিষ্কে। কারণ আপনি কাজ জানেন মানে আপনার আত্মবিশ্বাস থাকবে আকাশচুম্বী।
দিনটি একারণেই যাতে সেই সব মানুষকে একটা দিনের জন্য হলেও মনে করিয়ে দেওয়া যায়, দক্ষ হওয়া আসলেই কতটা দরকার। আর ঠিক এ কারণেই জাতিসংঘ এবং অন্যান্য সংস্থাগুলো জোর দিচ্ছে TVET অর্থাৎ Technical and Vocational Education and Training এর উপর। আর এই শিক্ষাগুলো দক্ষতা বাড়াতে সহায়তা করে। দক্ষতাগুলো সংস্থান করে দেয় ভালো কর্মের। একই কাজে দক্ষ এবং অদক্ষ লোকের পার্থক্যটা ধরা পড়ে অর্জিত আয়ের ক্ষেত্রে। দক্ষ লোক কাজ করতে গিয়ে খুব একটা আটকে যায় না। কাজ করে সে যেমন তৃপ্ত থাকে, প্রতিষ্ঠানও খুশি থাকে তার উপর।
দুঃখজনক হলেও সত্যি, ক্যারিয়ারের জন্য আমাদের যুবকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা খুবই অল্প। যে কয়েকটি আছে, সেগুলোর আবার প্রচারণা নেই। লোকে জানেও না যে আমাদের দেশে স্কিল ডেভেলপমেন্ট এর সুযোগ সরকারিভাবে যেমন আছে, বেসরকারি ভাবেও আছে। আর একেকটি দক্ষতা কাজে দেয় সারাজীবন। যা আপনাকে কিছু সাফল্য এনে দিবে, এর মধ্যে ব্যক্তিগত সাফল্যও আছে। ভেবে দেখুন, কোন কাজে সফলতা আপনাকে আনন্দ দেয়। তাই জীবনে অর্জন করা প্রতিটা সফলতাই কিন্তু আমাদের ব্যক্তিগত সফলতাও। যে কারণে আমাদের উৎসাহটা থাকবে সে-সব যুবকদের প্রতি, যারা কাজ করতে চান এবং আগ্রহও আছে। কাজ করতে করতে লোকে দক্ষ হয়, এ কথা কিন্ত খুব সত্যি। কিন্তু এর জন্য সবার আগে প্রয়োজন পড়বে দক্ষতার।
গ্রামবাংলায় একটা কথা খুব বলে, ‘হাত থাকলে ভাতের অভাব হয় না।’ আমাদের বোধহয় সে দিন চলেই এসেছে যেখানে গর্তে পড়ে গিয়ে আশা করা যাবে না কেউ এসে উদ্ধার করে যাবে।