ডন প্রতিবেদন : জাপান থেকে আসা দুই শিশুর মা এরিকো নাকানো ও বাবা ইমরান শরীফ দুজনেই তেজগাঁওয়ের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে গিয়েছিলেন সকালে। এরপর শিশুসন্তানেরা সিআইডির তত্ত্বাবধানে, বাবা তাঁর নিজের গাড়িতে আর মা তাঁর মতো করে আদালতে পৌঁছান। দুই বোন হাত ধরে জড়সড় হয়ে ঢোকে এজলাসে।
কয়েক পর্বে দুই পক্ষের আইনজীবী, স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে কথা বলে বেলা ৩টার পর আদালত সিদ্ধান্ত দেন আগামী ১৫ দিন শিশুরা মা-বাবাকে নিয়ে গুলশানের একটি ফ্ল্যাটে থাকবে। এই ফ্ল্যাটের খরচ বহন করবেন জাপানি নাগরিক এরিকো নাকানো ও তাঁর স্বামী বাংলাদেশি আমেরিকান ইমরান শরীফ। পারিবারিক সহিংসতার মতো কোনো ঘটনা যেন না ঘটে, সে জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক থাকবেন। নিরাপত্তা দেবে ঢাকা মহানগর পুলিশ ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। পরবর্তী আদেশের জন্য দিন ঠিক করা হয়েছে ১৬ সেপ্টেম্বর। তবে এর আগে কোনও পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে আদালতকে জানাতে পারবে উভয় পক্ষই।
বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের বেঞ্চ বলেন, সব পক্ষের বক্তব্য শুনে শিশুদের সর্বোচ্চ কল্যাণ বিবেচনা করে তাঁরা এই আদেশ দেন।
উল্লেখ করা যেতে পারে, জাপানি নাগরিক এরিকো নাকানো সন্তানদের জিম্মা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেছেন। অন্যদিকে তাঁর স্বামী ইমরান শরীফও বাংলাদেশের পারিবারিক আদালতে মামলা ঠুকেছেন। ইমরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি স্ত্রীর অনুমতি না নিয়ে জাল পাসপোর্ট বানিয়ে সন্তানদের জাপান থেকে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছেন। এই দম্পতির বিবাহবিচ্ছেদের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। ইমরান শরীফ বলেছেন, মেয়েরা স্বেচ্ছায় তাঁর সঙ্গে চলে এসেছেন। অ্যাপার্টমেন্ট কেনা, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে মতদ্বৈততা থেকে এই দম্পতির বিরোধ চরমে পৌঁছায়।
যেভাবে আদেশ : শিশির মনির আদালতকে বলেন, তাঁরা বারিধারায় একটি বাসা ভাড়া নিয়েছেন। সেখানে মা সন্তানদের সঙ্গে থাকবেন, বাবাও আসতে পারবেন। তিনি রাতটা সন্তানদের সঙ্গে কাটাতে চান গুনে গুনে ১৪ দিন। ইমরান শরীফ ভয় পাচ্ছেন তাঁকে না বলে শিশুদের জাপান নিয়ে চলে যেতে পারেন স্ত্রী। প্রয়োজনে তাঁরা পাসপোর্ট জমা রাখতে চান।
অন্যদিকে ফাওজিয়া করিম ফিরোজ জানান, তাঁর মক্কেলের বারিধারার বাসা নিয়ে আপত্তি আছে। ওই বাসা জাপান দূতাবাসের কাছাকাছি। তাঁরা গুলশানে একটি বাসা দেখেছেন। সেখানে বাবাও রাতে থাকতে চান।
শিশির মনির এবার বলেন, বাবা থাকলে পারিবারিক সহিংসতার মতো ঘটনা ঘটতে পারে, এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেন। ফাওজিয়া বলেন, সেটা দেখভালের দায়িত্ব সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের দেওয়া হোক। তাঁরা চান অন্তত এক সপ্তাহ বাবা যেন রাতে থাকার অনুমতি পান। সন্তানেরা একটা ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছে, সেটা কাটানো দরকার। শিশির মনির এর বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, সাত মাস সন্তানেরা বাবার সঙ্গেই ছিল। ১৪ দিন মায়ের সঙ্গে থাকলে সমস্যা কী? একপর্যায়ে আদালত তাঁদের সিদ্ধান্ত দেন।
কে জয়ী হলেন? : আদালতের এই আদেশের পর শিশুদের বাবা ইমরান শরীফ, তাঁর আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ ও এরিকো নাকানোর আইনজীবী শিশির মনির সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। আলাদা আলাদাভাবে প্রত্যেকের কাছেই জানতে চাওয়া হয়েছিল কে জিতলেন?
ইমরান শরীফ সাংবাদিকদের বলেন, ‘এখানে জেতা-হারার ব্যাপার নেই। মেয়েদেরকে দেখতে পারব রোজ, সেটার আনন্দ আমি কী বলব!...আমি তো ভেবেছিলাম সব হারিয়ে ফেলব আজকে। তবে লড়াইটা আরও অনেক লম্বা।’ ইমরান আরও বলেন, তিনি বাংলাদেশের একজন সাধারণ নাগরিক। তাঁকে দেশে বসে বিদেশিদের সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে। বাংলাদেশের ইতিহাস আছে, বাংলায় কথা বলতে না দেওয়ায় দেশ স্বাধীন করার। সেই চেতনা তিনি ধারণ করেন, শ্রদ্ধা করেন।
সমঝোতায় কেন এলেন না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেই চেষ্টা তিনি করে যাচ্ছেন।
ইমরানের আইনজীবী ফাওজিয়া করিম বলেন, আজ জয় হয়েছে শিশুদের। তিনি সে কারণে খুশি। আদেশ এসেছে তাঁর দেওয়া প্রস্তাবমতো।
ফাওজিয়া বলেন, ‘বাচ্চাদের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে যেভাবে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল! রাইট অর রং হয়তো অনেক দিন মাকে দেখেনি। তারা ভয় পাচ্ছে। সে কারণে যদি রাতের বেলা মা থাকত হয়তো ওদের অন্য রকম লাগত। তাই প্রস্তাব ছিল একই ছাদের নিচে মা-বাবা থাকবে, যেন বাচ্চাদের মনে স্টেবিলিটি (স্থিতি) আসে। কারণ, বাচ্চাদের জন্য মা-বাবা দুজনেই ইকুয়ালি ইম্পর্টেন্ট (সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ)।’
ইমরান শরীফের আইনজীবী বলেন, তিনি মনে করেন এই দম্পতির মধ্যে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, তা হয়তো কমে আসবে। এতে শিশুদের স্বার্থ সবচেয়ে ভালোভাবে রক্ষিত হবে।
এরিকো নাকানোর আইনজীবী শিশির মনিরের কাছে প্রশ্ন ছিল, আদালতের এই আদেশে তিনি সন্তুষ্ট কি না। জবাবে তিনি বলেন, ‘পারিবারিক বিষয়ে সবাইকে কমবেশি ছাড় দিতে হয়। একসময় তো ওনারা শিশুদের নিজেদের বাসায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। একটা দরখাস্তও দিয়েছিলেন। মা শুধু দেখতে পাবেন। সেখান থেকে আমরা পারস্পরিক ঐকমত্যের কাছাকাছি পৌঁছাতে পেরেছি।’
শিশির মনির আরও বলেন, ‘এখানে হারজিতের কিছু নেই। এখানে কথা হলো পরিবার নিয়ে যদি তারা থাকতে পারে, যদি তাদের সম্পর্কের উন্নয়ন হয়, বাচ্চাদের কল্যাণ হয়, তাহলে কে হেরেছে, কে জিতেছে, সেটা ইম্পর্টেন্ট (জরুরি) নয়। আদালতের আদেশ অনিবার্য।’ তিনি আশা করেন এই ১৫ দিনে তাঁদের সম্পর্কের উন্নয়ন হবে। শিশুকন্যারা অপেক্ষাকৃত ভালো পরিবেশ পাবে। তারা মানসিক স্বস্তি পাবে।
তবে শিশির মনির বলেন, তাঁদের সংসারে যে ঝামেলা, তা এক দিনে হয়নি। আগেও তাঁদের মধ্যে মতবিরোধ ছিল। যে কারণে মেয়েদের নিয়ে তিনি চলে আসেন । তিনি পাসপোর্ট বানিয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে দুইবার সরাসরি কথা হয়েছে আইনজীবীদের। কথাবার্তা যা হয়েছে তাতে মনে হয়েছে, একসঙ্গে থাকতে দিলে দুজনের অসুবিধা হতে পারে। কিন্তু আদালত যেহেতু সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, তাই দুপক্ষকেই কাউন্সেলিং করে দেখবেন যেন সমস্যা না হয়।