সর্বজনীন পেনশন সীমিত পরিসরে ৫ বছর
নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ : চলতি বছরের ডিসেম্বর কিংবা আগামী বছর জানুয়ারিতে দেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। তার আগেই নির্বাচনি প্রতিশ্রুতিতে রাখা ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা’ চালু করতে চায় সরকার। বর্তমানে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য পেনশন ব্যবস্থা চালু আছে। সরকারের লক্ষ্য এর বাইরে দেশে বেসরকারিভাবে কর্মরত ও কর্মহীন অন্যান্য শ্রেণিপেশার নাগরিককেও পেনশন সুবিধার আওতায় আনা। এখন একাদশ সংসদের শেষ বছরে দাঁড়িয়ে সেই অবাস্তবায়িত প্রতিশ্রুতি পূরণের তোড়জোড় চেষ্টা চলছে। সেই ধারাবাহিকতায় আগামী ১ জুলাই থেকে চালু করা হচ্ছে ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা’ স্কিমের পাইলটিং কার্যক্রম। যার শুরুতে মডেল জেলা হিসেবে রাখা হবে ঢাকাসহ দেশের অন্য যে কোনও একটি জেলাকে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, এই পাইলটিং মডেল স্কিমের মেয়াদ হতে পারে সর্বনিম্ন এক বছর থেকে সর্বোচ্চ দুই অর্থবছর। এ কার্যক্রমে পাইলটিং জেলায় নিবন্ধিত পেনশনারদের মাসিক কিস্তি সংগ্রহের দায়িত্বে থাকবে স্থানীয় ব্যাংকিং ব্যবস্থার পাশাপাশি দেশে প্রচলিত মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসরাও (এমএফএস)। বিভিন্ন স্থান থেকে পেনশনারদের জমা করা ওই অর্থ স্বয়ংক্রিয়ভাবে যোগ হয়ে যাবে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রিত সার্ভারে। এর সাফল্যের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা’ একই পদ্ধতিতে সারা দেশে বিস্তৃত করা হবে। তবে শুরুর প্রক্রিয়াটি হবে সীমিত পরিসরেই। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা সারা দেশে চালু হওয়ার পর অন্তত পাঁচ বছর তা ঐচ্ছিক রাখা হবে। পরে ২০২৮-২০৩০ সালের মধ্যে এটি সবার জন্য বাধ্যতামূলক করা হতে পারে, যার হালনাগাদ অগ্রগতি ও আগামীর পরিকল্পনা প্রত্যেক অর্থবছর সরকারের বাজেট উপস্থাপনের সময় তুলে ধরা হবে।
এদিকে, নামে সর্বজনীন এই পেনশন ব্যবস্থা শুরুর প্রথম ১০ বছর সবার জন্য হচ্ছে না। আইন অনুযায়ী কেবল ১৮ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে থাকা দেশে ও বিদেশে কর্মরত নাগরিকরাই সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তি হওয়ার সুযোগ পাবেন। যদিও সেক্ষেত্রে ৫০-৫৯ বয়সীদের বিশেষ শর্ত পূরণ সাপেক্ষে এ ব্যবস্থায় যুক্ত হওয়ার সুযোগ রাখা হবে। তারপরও এই বয়সী জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ থাকতে পারবে না সর্বজনীন ব্যবস্থায়।
অন্যদিকে, আইন অনুযায়ী এ ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর একজন নিবন্ধিত পেনশনারকে অন্তত ১০ বছর কিস্তি চালিয়ে যেতে হবে। এ ক্ষেত্রে সর্বজনীন পেনশনের ধরন বা পেনশন প্রোডাক্ট সংখ্যা সর্বোচ্চ (১৮-৫০) =৩২ রকমের হতে পারে। তবে এসব প্রোডাক্ট থেকে পেনশনারের লাভের সিলিং নির্ধারিত হবে তিনি সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় কত টাকা হারে জমা করতে চান, তার ওপর ভিত্তি করে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত ৫ জানুয়ারি বসেছে একাদশ জাতীয় সংসদের ২১তম অধিবেশন। রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে এ অধিবেশন আহ্বান করেছেন। সব কিছু ঠিক থাকলে চলতি অধিবেশনেই সংসদ সদস্যদের কণ্ঠভোটে বহুল প্রত্যাশিত সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষ আইন ২০২২ পাস হবে। আইনটি ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা বিল ২০২২’ হিসেবে পরিচিতি পাবে। এ আইন পাস হওয়ার পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে ‘জাতীয় পেনশন ব্যবস্থা কর্তৃপক্ষ’ গঠনের কাজ শেষ হবে। কর্তৃপক্ষ পক্ষ গঠনের কাজ শেষ হলে পরবর্তী দুই মাসের মধ্যে ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা বিল ২০২২’ নামে প্রণীত আইনটি প্রয়োগের জন্য বিধিমালা তৈরির কাজ শেষ করবে। আর প্রণীত আইন ও বিধিমালার আলোকেই দেশে প্রথমবারের সর্বজনীন পেনশন স্কিম-এর মাঠপর্যায়ের পাইলটিং কার্যক্রম মতো শুরু হবে।
জানা গেছে, এর আগে গত বছরের ২৯ মার্চ সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা আইন-২০২২-এর খসড়া প্রণয়ন শেষে বিভিন্ন অংশীজনের কাছে মতামত চাওয়া হয়। এতে ৩৬ ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা থেকে মতামত পাওয়া যায়। এসব মতামতের ওপর ভিত্তি করে ওই বছরের ১৬ মে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় আইনটি পূর্ণাঙ্গ ও চূড়ান্ত করা হয়। পরে এর ওপর ভেটিং শেষে খসড়াটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে উপস্থাপন করা হলে তা পর্যালোচনা করে আইনে পরিণত করতে গত ৩০ অক্টোবর থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত চলা ২০তম অধিবেশনের কার্যতালিকায় ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা বিল ২০২২’ পাসের জন্য তোলা হয়। তবে জাতীয় সংসদ থেকে আইনটি অধিকতর পর্যালোচনার জন্য সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠায়। পরে আইনটিতে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিও তাদের কিছু নির্দেশনা রেখেছে, যা অন্তর্ভুক্ত করার পর ফের ২১তম সংসদ অধিবেশনের কার্যতালিকায় এখন অপেক্ষমাণ।
এর আগে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া এই প্রতিবেদককে জানান, ‘দেশে যত দ্রুত সম্ভব সর্বজনীন পেনশন প্রথা চালু করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুবই আন্তরিক। জুলাই-২০২৩-এর মধ্যেই এটি বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে সরকার।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (প্রবিধি-১ অধিশাখা) মনির হোসেন চৌধুরী বাঙলার কাগজ ও ডনকে জানান, সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারব না। তবে এ অধিবেশনে আইনটি পাস হতে পারে। তবে যখনই পাস হোক না কেন, আগামী জুলাই থেকে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা’ স্কিমের পাইলটিং শুরু করার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, বয়সভিত্তিক হিসেবে দেশে ১৮ থেকে ৪৯ বছর বয়সী জনসংখ্যা গড়ে সাড়ে ৭ কোটি। আর শ্রমবাজারের ৮৫ শতাংশ জনবল নিয়োজিত আছে অনানুষ্ঠানিক খাতে। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় মোটাদাগে এ বয়সসীমায় থাকা সব নাগরিক পর্যায়ে ক্রমেই সর্বজনীন পেনশন সুবিধার আওতায় আসবে।
এদিকে, ২০২০ সালে দেশে ষাটোর্ধ্ব জনসংখ্যা ছিল ১ কোটি ২০ লাখ। এই সংখ্যা ২০৪১ সালে ৩ কোটি ১০ লাখ হবে বলে অনুমান করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণে ধীরে ধীরে দেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকবে। বর্তমানে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো কাঠামো না থাকায় বৃদ্ধকালে তাদের জীবনযাপনে অনিশ্চয়তা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা আছে। ওই সময় তাদের স্বাচ্ছন্দ্য জীবনযাপনে আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিতেই বর্তমান সরকার সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করতে যাচ্ছে।
সবার জন্য পেনশন আওয়ামী লীগের গত আমলের চিন্তা। আবুল মাল আব্দুল মুহিত অর্থমন্ত্রী থাকাকালে ২০১৭-১৮ সালের প্রস্তাবিত বাজেটে তিনি একটি রূপরেখা দিয়েছিলেন। এ জন্য পাইলট প্রকল্পের কথা বলেছিলেন তিনি। সর্বজনীন পেনশনকে মুহিত তার স্বপ্নের প্রকল্প উল্লেখ করলেও একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর আ হ ম মুস্তফা কামাল অর্থমন্ত্রী হওয়ার পর এ বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে কাজ চলেনি। তবে সরকারের নানা কাজ যে পর্দার আড়ালে হয়েছে, সে বিষয়টি স্পষ্ট হয় গত বছর ১৭ ফেব্রুয়ারি। সেদিন একটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রবর্তন’ বিষয়ে একটি উপস্থাপনা দেয় অর্থ বিভাগ। এরপর প্রধানমন্ত্রী ষাটোর্ধ্ব জনগণের জন্য সর্বজনীন পেনশন স্কিম প্রণয়ন এবং কর্তৃপক্ষ স্থাপনের নির্দেশ দেন। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার আলোকে বিভিন্ন নির্দেশনার পাশাপাশি জরুরি ভিত্তিতে আইন করার উদ্যোগ নিতে অর্থ বিভাগকে নির্দেশও দেন তিনি।
পাইলটিংয়ের আগে জাতীয় পেনশন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ গঠন: সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন ২০২২ অনুযায়ী আগে গঠন হবে জাতীয় পেনশন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। যার নিয়ন্ত্রণে থাকবেন একজন নির্বাহী চেয়ারম্যান। তবে চেয়ারম্যানকে কাজে সহায়তা দেওয়ার জন্য থাকবেন আরও চারজন সদস্য। তারা সরকার কর্তৃক মনোনীত হবেন বা নিয়োগ পাবেন। মূলত এই কর্তৃপক্ষই দেশে প্রবর্তিত হতে যাওয়া সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার তদারক করবে। তাদের নিজস্ব কার্যালয় ও প্রয়োজনীয় জনবল থাকবে। সারা দেশে প্রয়োজন অনুযায়ী শাখাও স্থাপন করতে পারবে। সবখানে সব পেনশনারের হিসাব সংরক্ষিত হবে একটি কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রিত ডাটা সেন্টারে। নিবন্ধিত পেনশনারদের অর্থ লাভজনক খাতে বিনিয়োগ পরিচালনা, যে কোনো দাবি, আপত্তি এই কর্তৃপক্ষ নিষ্পত্তি করবে। তবে এ কর্তৃপক্ষের কাজ দেখভালের জন্য থাকবে অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি উচ্চপর্যায়ের গর্ভনিং বোর্ড।
মোটাদাগে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা আইনে যা থাকছে : প্রত্যেক নাগরিকের জন্য একটি আলাদা পেনশন হিসাব থাকবে। ফলে তিনি চাকরি পাল্টালেও পেনশন হিসাব অপরিবর্তিত থাকবে। এ পেনশন পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকবে। তবে এ ক্ষেত্রে কর্মী বা প্রতিষ্ঠানের চাঁদা জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত হবে।
নিবন্ধিত চাঁদা জমাকারী পেনশনে থাকাকালে ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে মারা গেলে জমাকারীর নমিনি অবশিষ্ট সময়কালের (মূল জমাকারীর বয়স ৭৫ বছর পর্যন্ত) জন্য মাসিক পেনশন পাবেন। কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা প্রদান করার আগে নিবন্ধিত চাঁদা প্রদানকারী মারা গেলে জমা করা অর্থ মুনাফাসহ তার নমিনিকে ফেরত দেওয়া হবে।
পেনশন স্কিমে জমা অর্থ কোনো পর্যায়ে এককালীন উত্তোলনের সুযোগ থাকবে না। তবে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জমাকৃত অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ হিসেবে তোলা যাবে, যা সুদসহ পরিশোধ করতে হবে।
পেনশনের জন্য নির্ধারিত চাঁদা বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করে কর রেয়াতের জন্য বিবেচিত হবে এবং মাসিক পেনশন বাবদ প্রাপ্ত অর্থ আয়কর মুক্ত থাকবে।
নিম্ন আয়সীমার নিচের নাগরিকদের ক্ষেত্রে পেনশন স্কিমে মাসিক চাঁদার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে দিতে পারে।