কলাম : যেসব কারণে বাদ দেব না জাতীয় সংগীত
রাজু আলাউদ্দিন :: আমান আযমী জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমের সন্তান। তিনি যদি জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পৃক্ত নাও হয়ে থাকেন, তারপরও তার বক্তব্যকে ওই দলটির পরোক্ষ দাবি হিসেবে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। তারা এই দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ৭১ সালে পরাজিত হয়েছিল। আজও যখন তারা নির্বাচনে দাঁড়ায় তখন গুটিকয় আসন ছাড়া পায় না।
তারা সর্বশেষ যে-নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল তাতে পেয়েছিল মাত্র দুটি আসন । সুতরাং এই সামান্য জনসমর্থন নিয়ে একটি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধিত্ব তারা যে করে না— এটা পরিষ্কার। কিন্তু তবু নানা সময়ে তারা এই দেশের মৌলিক নীতিমালা এবং মীমাংসিত বহু বিষয়ে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে জাতীয় জীবনে অস্থিরতা আনার চেষ্টা করেছে।
সেই অস্থিরতার সর্বশেষ নজির জাতীয় পতাকা আর জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবি। দাবিটি যদিও এবার জামায়াতের কেউ তোলেনি, কিন্তু আব্দুল্লাহহিল আমান আযমী জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের সন্তান বলে এটিকে পরোক্ষে জামায়াতের দূরভিসন্ধিরই প্রকাশ বলে মনে করা হচ্ছে। কারো কারোর ধারণা আমান আযমীর মাধ্যমে তারা জনমত জরিপ করছে এই তর্কটিকে সামনে এনে। এই সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয় এই কারণে যে জামায়াতে ইসলামী আমান আযমীর এই বক্তব্যের কোনো বিরোধিতা করে নি।
রবীন্দ্রনাথের রচিত ভারতের জাতীয় সাংগীতটি নিয়েও নানা সময়ে তর্ক উঠেছে। এবং এই বিতর্কের জন্মদাতা সে দেশের মৌলবাদী রাজনৈতিক সংগঠন। বাংলাদেশেও রবীন্দ্রনাথের রচিত জাতীয় সংগীতটি বর্জনের দাবি জানিয়ে এসেছে এই দেশের মৌলবাদী চিন্তার অনুসারীরা। উভয় দেশের মৌলবাদীরা পরস্পরকে ঘৃণা করলেও জাতীয় সংগীত বর্জনের বেলায় তারা একই বৃন্তের দুটি ভুল।
ভারতের জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবি ওঠা প্রসঙ্গে শঙ্খ ঘোষ একবার লিখেছিলেন: “আমাদের জাতীয় সংগীতটি কি দেশাত্মবোধক গান, না কি নিছক সম্রাটবন্দনা? গোটা ভারত জুড়ে এমন একটা সংশয়ের কথা মাঝে মাঝেই জেগে ওঠে। শুধু লোকমুখে নয়, তীব্র প্রশ্নাকারে সে-সংশয় বারে বারেই উচ্চারিত হয় এমনকী লোকসভাতেও। এমন দাবিও কখনো কখনো ওঠে যে জাতীয় সংগীত হিসেবে পালটে দেওয়া হোক এ-গান,” (অল্পস্বল্প কথা, পৃ ৫৮)
ওদের ওখানেও রবীন্দ্রনাথের গানটিকে বর্জনের আওয়াজ তোলা হয়েছিল মূলত এই অজুহাতে যে ওটাতে ভারতের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষাতো নেই-ই, অধিকন্তু এটি নাকি তৎকালীন ইংরেজ সম্রাট পঞ্চম জর্জের বন্দনায় রচিত। এনিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। এই কুতর্ক যে অসার ও ভুল তা শ্রী প্রবোধচন্দ্র সেন খন্ডন করেছিলেন বিপুল তথ্যউপাত্তের মাধ্যমে। লিখেছেন রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্তও। তারপরও মাঝেমধ্যেই এই সংগীত পরিবর্তনের আওয়াজ তুলেছে ভারতের বহুত্ববাদবিরোধী মৌলবাদী শক্তিগুলো। এই দেশেও জাতীয় সংগীত নিয়ে প্রায় একইভাবে মাঝেমধ্যে সপ্তমে চড়তে দেখি।
কারা এর পরিবর্তন চাইছে? সেই তারা যারা এই দেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল। সুতরাং এই দেশের পতাকা ও জাতীয় সংগীতের পরিবর্তন তারা যে মেনে নেবে না এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু করুণ এক স্ববিরোধিতা এই যে এই দেশের স্বাধীনতা অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেনে নিয়ে এই স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে তারা বসবাস করছে ঠিকই, কিন্তু এই মেনে নেয়ার গ্লানি তাদেরকে কিছুতেই ভুলতে দেয় না যে তারা পরাজিত। পরাজয়ের দুঃস্বপ্ন থেকেই তারা স্বপ্নের ঘোরে আজও আবোলতাবোল বকতে গিয়ে এই পরিবর্তনের প্রসঙ্গ সামনে নিয়ে আসে। গোপন উদ্দেশ্য আড়ালে রেখে তারা এই দেশের পতাকা ও জাতীয় সংগীতের পরিবর্তন চায়।
পরিবর্তনের পক্ষে প্রধান কারণ হিসেবে যে-কথাগুলো তারা বলে তার একটি হচ্ছে, এটি ‘স্বাধীনতার অস্তিত্বের পরিপন্থি’। আমান আযমী বলেন, “১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গ-রদ করার জন্য রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। এই জাতীয় সংগীত দুই বাংলা এক করার জন্য জাতীয় সংগীত। আমরা কি দুই বাংলা এক হতে চাচ্ছি? আমরা কি স্বাধীন বাংলাদেশ রাখতে চাই, নাকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অঙ্গীভূত রাজ্য হতে চাই?
“আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ চেয়েছি, স্বাধীন বাংলাদেশে থাকতে চাই। এই জাতীয় সংগীত আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের পরিপন্থি। আমি জোর দাবি জানাচ্ছি আমাদের নতুন জাতীয় সংগীত তৈরি করা হোক।”
যারা এই দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধাচারণ করেছে তারাই এখন এই দেশের স্বাধীনতার অস্তিত্ব সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি চিন্তিত। এর চেয়ে বড় ব্যাজস্তুতি আর হয় না।তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই যে বঙ্গবঙ্গ বিরোধী অবস্থান নিয়ে রবীন্দ্রনাথ রাজনৈতিক ভুল করেছিলেন, কিন্তু এই গানটিতে তার সেই রাজনৈতিক ভুলের কোনো প্রতিফলন নেই, কারণ গানটিকে তিনি তার রাজনৈতিক আদর্শের কোনো প্রচারপত্র বানিয়ে তোলেননি।অন্যদিকে, রবীন্দ্রনাথ যে-সময়ের প্রেক্ষাপটে এই গান লিখেছিলেন সেই সময়ের দাবি মেটানোর পরেও এটি আমাদের কাছে এখনও পর্যন্ত প্রাসঙ্গিক।প্রাসঙ্গিক এই কারণে যে গানটি বৃহত্তর বঙ্গবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করার আকাঙ্ক্ষা থেকে হলেও এই গানে বঙ্গকে ঐক্যবদ্ধ রাখার কোনো উল্লেখই নেই, এতে প্রধান হচ্ছে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক রূপ লাবণ্য ও মাতৃপ্রতিম দেশের প্রতি ভালোবাসা। এই গানটির কোথাও ঐক্য কিংবা বিভেদমূলক একটি শব্দই নেই। দেশাত্মবোধই এই গানের প্রধান বক্তব্য। ফলে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতার যে অজুহাত তোলা হচ্ছে সেটি খঞ্জ ও অসাড়।অধিকন্তু একটি রচনা কী উদ্দেশ্যে কী প্রেক্ষাপটে এবং কার দ্বারা রচিত হয়েছে, সেটি দিয়ে কোনো শিল্পের বক্তব্য বিচার করাটা পুরোপুরি অবান্তর। আদালতের ভাষা ও মানদণ্ড দিয়ে সাহিত্যের বিচার হয় না। মহৎ সাহিত্য সবসময়ই দেশ কাল অতিক্রম করে যায় বলেই তার আবেদন শাশ্বত। নজরুল ইসলামের ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ বৃটিশ শাসনের বিরোধিতা থেকে রচিত হলেও, এটিকে শুধুই সেই প্রেক্ষাপটে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে– একথা কি আমরা বলতে পারি? কোনো সাহিত্য বা শিল্পকর্মই রচনাকাল, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও দেশকালের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকে না বলেই শেক্সপিয়রের নাটকগুলো চিরন্তন আবেদন নিয়ে আমাদের কাছে আজও প্রাসঙ্গিক হয়ে আছে। ‘হ্যামলেট’ ডেনমার্কের আর ‘জুলিয়াস সিজার’ রোমের ঐতিহাসিক ঘটনা অবলম্বনে রচিত হলেও মূল ঘটনার সঙ্গে দুটি নাটকের যে পার্থক্য রয়েছে, আমাদের জাতীয় সংগীতের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই ঘটেছে। বঙ্গভঙ্গ বিরোধিতা যদি এই গানের উপলক্ষ হয়েও থাকে, সেই প্রেক্ষাপট ও ঘটনার প্রতি এই গানের বিন্দুমাত্র আনুগত্য নেই। এটি ঘটনা ও কালনিরপেক্ষ দেশাত্মবোধের দ্বারা অনুপ্রাণিত বাঙালির আবেগ, অনুভূতি ও ভালেবাসার এক শিল্পিত প্রতিনিধি হয়ে উঠেছে। আর তাই এটিকে আমাদের স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী বলার কোনো যুক্তিই নেই। একইভাবে এই গানে বাংলাদেশের উল্লেখ নেই বলে একে খারিজ করারও কোনো অজুহাত ধোপে টিকবে না। কারণ পৃথিবীর অনেক দেশের জাতীয় সংগীতেই সেই দেশের নামের উল্লেখ নেই। মেক্সিকোর জাতীয় সংগীতটিতে একবার মাত্র ‘মেক্সিাকান’ শব্দটির উল্লেখ আছে, কিন্তু ‘মেক্সিকো’ শব্দটির উল্লেখ ওই গানটির কোথায়ও নেই। তারপরও এটি ১৭০ বছর যাবত কোনো রকম তর্কবিতর্ক ছাড়াই বহাল আছে। ১৭৯২ সালে রচিত ফ্রান্সের জাতীয় সংগীতটিতেও ফ্রান্সের উল্লেখ নেই, আছে কেবল পিতৃভূমির উল্লেখ।এমনকী, সৌদি আরবের জাতীয় সংগীতেও কোথাও সৌদি আরব তো দূরের কথা, আরব শব্দটিও নেই; আছে ‘আমার দেশ’ বা ‘স্বদেশ’ শব্দটি। সুতরাং হুবহু বাংলাদেশের নাম থাকতেই হবে, আর তা না থাকলে সেটি আমাদের স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী হয়ে যাবে— এই দাবি ও তর্ক পুরোপুরি ভিত্তিহীন।
তা ছাড়া, বাংলাদেশ বললে যে অখণ্ড বাংলাকে বুঝাবে না, সেটা এই কারণে যে বঙ্গের যে-ধারণা আমাদের মধ্যে আছে সেটির ভৌগোলিক কেন্দ্রবিন্দু এই বাংলাকেই নির্দেশ করে। ফলে, এই গানের কারণে বাংলাদেশ কেন্দ্রচ্যুত হবে না কোনভাবেই। ইতিহাসবিদ আবদুল মমিন চৌধুরী ঐতিহাসিক আবুল ফজলের সূত্রে এই অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান নির্দেশমূলক এক লেখায় বলেছেন: “নদীমাতৃক বারিবহুল দেশে বৃষ্টি, বন্যা ও জোয়ারের স্রোত রোধের জন্য ছোট বড় বাঁধ (‘আল’) বাঁধা কৃষি ও বাস্তুভূমির যথার্থ পরিপালনের পক্ষে অনিবার্য।” আবুল ফজলের ধারণার সমর্থনে ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায় বলেছেন: “আবুল ফজলের ব্যাখ্যার অর্থ এই যে বঙ্গদেশ আল বা আলিবহুল,যে-বঙ্গদেশের উপরিভূমির বৈশিষ্ট্যই হইতেছে আল সেই দেশই বাঙ্গালা বা বাংলাদেশ। এই আলগুলিই আবুল ফজলের সবিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিল; তাঁহার ব্যাখ্যা পড়িলে এই কথাই মনে হয়।” (বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-১ খণ্ড, প্রধান সম্পাদক আনিসুজ্জামান, বাংলা একাডেমি, জুলাই ২০১৯, পৃ ৪) বাংলা বা বাংলাদেশ বলতে মূলত এই ভূখণ্ডকেই বুঝায়, যদিও তার প্রান্তীয় অঞ্চল হিসেবে আজকের পশ্চিমবঙ্গের কোনো কোনো অঞ্চলও অন্তুর্ভুক্ত। কিন্তু সেটি এই গানের কোনো প্রসঙ্গ নয়। এটি এমনই এক গান যেটি পশ্চিমবঙ্গের যে-কোনো নাগরিক গাইতে পারেন তাদের ভূখণ্ডের প্রতি অনুরাগ থেকে। কিন্তু সেই অনুরাগ আমাদের দেশাত্মবোধকে কোনভাবে খাটো যেমন করে না, তেমনি তা বাধাগ্রস্তও করে না। কারণ এই গানটি নদনদীবহুল সবুজ ভূখণ্ডময় যে-কোনো দেশের নাগরিকের কন্ঠেই গীত হতে পারে ভূগোলনির্দেশক বাংলা শব্দটি বদলে নিয়ে— এমনই সর্বব্যাপী এক আবেদনে পূর্ণ এই গান। সুতরাং এই গানে বাংলাদেশ শব্দটি আছে কি নেই, থাকলেও খণ্ডিত না অখণ্ডিত বাংলা– এই কূটতর্কও অর্থহীন এবং নিশ্চিতভাবেই অত্যন্ত সংকীর্ণ এক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ।
কেউ কেউ আপত্তির কথা জানিয়েছেন এই গানের অনুগ্র ভাব নিয়ে; তাদের অভিমত: এই গানের সুর ও বক্তব্যে জাতিকে উজ্জীবিত করার কিছু নেই। এই উজ্জীবিত করার কথা বলতে তারা কী বুঝাতে চান? জাতীয় উন্মাদনার জোস, যুদ্ধংদেহি মনোভাবের প্রকাশ? রণমূর্তির চণ্ড প্রকাশ? সেটাই বা থাকতে হবে কেন? পরাধীন দেশকে মুক্ত করার জন্য সে রকম কোনো জোসের কোনো প্রয়োজন যে দেখা দিতে পারে না, তা নয়। কিন্তু একটি স্বাধীন দেশে তার কী প্রয়োজন? রবীন্দ্রনাথের এই গানটিতে খুবই যথার্থ কারণে দেশাত্মবোধ আছে, কিন্তু জাতীয়তাবাদের রণমূর্তি নেই। যে-তিনটি দেশের জাতীয় সংগীতের উল্লেখ করেছি, তার দুটিরই ভাষায় ও বক্তব্যে উগ্র ও চণ্ড এক অভিব্যক্তি রয়েছে। মানুষের উন্মাদনার অনুভূতিকে যত সহজে জাগিয়ে তোলা যায়, মানুষের মানবীয় কোমল অনুভূতিকে জাগিয়ে তোলা তত সহজ নয়। আমাদের জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে আমাদের মানবীয় প্রবৃত্তির যে শান্ত ও সৌন্দর্যপ্রিয় অনুভূতির প্রকাশ রয়েছে তা পৃথিবীর বেশির ভাগ জাতীয় সংগীতেই নেই। এই জায়গাতেই আমাদের জাতীয় সংগীতের অনন্য এক বৈশিষ্ট্য। আমাদের গর্ব করা উচিত যে আমরা অন্য সব জাতির মতো গর্বোদ্ধত ও অহংকারী চেতনার প্রকাশ ঘটাইনি জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে। গর্ব ও অহংকার দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে সংযোগ নয়, বরং বিভাজনের এক বীজ হয়ে ওঠে। এবং তার চূড়ান্ত রূপ হয়ে ওঠে ফ্যাসিবাদ। রবীন্দ্রনাথ এই গানের মাধ্যমে গোটা পৃথিবীর কাছে আমাদেরকে শান্তিপ্রিয়, সৌন্দর্যপ্রিয় ও নিরহংকার এক সভ্য জাতি হিসেবে তুলে ধরেছেন।
কেউ কেউ এই গানটির পরিবর্তে ডি এল রায়ের ‘ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা’ গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্বাচনের প্রস্তাব করেছেন। এই গানটি আমার খুবই প্রিয়। সন্দেহ নেই এই গান এক সময় বহু ভারতীয়কে উদ্বেল করেছিল।এই দেশের প্রতি প্রবল এক অনুরাগকে তিনি অত্যন্ত আলংকারিক শব্দে ও বাক্যে তুলে ধরেছেন। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে ডি এল রায়ের গানটিতে দেশাত্মবোধ আছে ঠিকই, কিন্তু এই দেশাত্মবোধের একটা সংকীর্ণ রূপ হচ্ছে অন্য দেশগুলোকে আহত করার উপাদান। যখন তিনি বলেন, ‘সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি’ তখন পরোক্ষে অন্য জাতির অন্য দেশকে প্রজা বা নিম্নবর্গীয় করা হয়। ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি যে-কোনো বিদেশি গাইতে গিয়ে অস্বস্তি বোধ করবেন না, কিন্তু ডি এল রায়ের গানটি গাইতে গিয়ে তিনি অস্বস্তিতে পড়বেন। রবীন্দ্রনাথ তার দেশাত্মবোধক কোনো গান বা কবিতাতেই এমন কোনো উক্তি করেননি যা অন্য দেশের বা জাতির জন্য বিব্রতকর হতে পারে। তিনি আমাদের বাংলা সাহিত্যের সেই প্রথম লেখক যিনি দেশাত্মবোধের সঙ্গে আন্তজার্তিকতাবোধের কোনো বিরোধ তৈরি করেননি।তিনি অসংখ্য দেশাত্মবোধক কবিতা লিখেছেন যা অনুভূতির প্রগাঢ়তায় আমাদেরকে আপ্লুত করে কিন্তু অন্য দেশ বা জাতির চিত্তকে তা ব্যাহত করে না। সুতরাং ডি এল রায়ের গানটি জাতীয়তার যে সংকীর্ণ ধারণা দ্বারা উদ্বুদ্ধ, ‘আমার সোনার বাংলা’ তা থেকে পুরোপুরি মুক্ত।
তবু মাঝেমধ্যে এই গান নিয়ে তর্ক ওঠে। আর তর্কটা ওঠে সাধারণত সেই মৌলবাদী গোষ্ঠীর পক্ষ থেকেই যারা এই দেশের স্বাধীনতাকে মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেনি। তারা রবীন্দ্রনাথকে বর্জন করতে চেয়েছিল সেই ষাটের দশক থেকেই। আজকে সরাসরি রবীন্দ্রনাথকে বর্জনের কথা না বললেও, জাতীয় সংগীতটি বর্জনের মাধ্যমে তাদের সেই পুরোনো দুরভিসন্ধিকেই সামনে নিয়ে আসতে চাইছে।
তাদের উদ্দেশ্যে হুমায়ূন আজাদের সেই কথাগুলো এই মুহূর্তে মনে পড়ছে: “রবীন্দ্রনাথ– যাঁকে বাতিলের চেষ্টা করে আসছে নষ্টরা পবিত্র পাকিস্তানের কাল থেকে; পেরে ওঠে নি। এমনই প্রতিভা ঐ কবির, তাঁকে বেতার থেকে বাদ দিলে তিনি জাতির হৃদয় জুড়ে বাজেন; তাঁকে পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দিলে তিনি জাতির হৃদয়ের কাব্যগ্রন্থে মুদ্রিত হয়ে যান, তাঁকে বঙ্গভবন থেকে বাদ দেওয়া হলে তিনি সমগ্র বঙ্গদেশ দখল করেন; তাঁর একটি সঙ্গীত নিষিদ্ধ হলে তিনি জাতীয় সঙ্গীত হয়ে ওঠেন।
প্রতিক্রিয়াশীল নষ্টরা অনেক লড়াই করেছে তাঁর সঙ্গে, পেরে ওঠে নি; তাঁকে মাটি থেকে বহিষ্কার করা হলে তিনি আকাশ হয়ে ওঠেন; জীবন থেকে তাঁকে নির্বাসিত করা হলে তিনি রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন জাতির স্বপ্নালোকে। নষ্টরা তাকে মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে আপ্রাণ। যদিও তিনি জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা,তবুও তিনি জাতীয় কবি নন।”
জানি, অতীতের ভূত মাঝেমধ্যেই ভবিষ্যতে আসবে, যেমন এসেছে আজকের দিনে, তবে তারা পেরে উঠবে না। কারণ এই গান যারা বদলাতে চায় তারা সংখ্যায় করমেয়। কিন্তু জাতীয় সংগীত আমাদের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অন্তরে এমনভাবে অচ্ছেদ্য হয়ে আছে যে এটিকে আলাদা করা মানে আমাদের জাতিসত্তার অঙ্গচ্ছেদ করা। তাছাড়া, শহীদ, প্রয়াত ও জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের কণ্ঠে এই গান গীত হয়েছে এবং তারা এই গান দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশকে স্বাধীন করার জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন, ফলে তাদের স্মৃতির প্রতি সম্মান দেখাবার জন্য হলেও এই গান আমরা কোনোভাবেই বাদ দিতে পারি না। দেশের জন্য যারা লড়াই করেছেন তাদের সিদ্ধান্ত ছাড়া এই গান কোনো অজুহাতেই বদলানো যাবে না। যারা যুদ্ধ করেনি, যারা এই দেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিল না, এই গান বদলাবার অধিকার তো দূরের কথা, এ সম্পর্কে কোনো অভিমত জানাবারই অধিকার তাদের নেই।