স্পিকার ও ড. মসিউর : বিশ্বব্যাংক নিজেদেরকেই বঞ্চিত করেছে, তাঁদের ঋণ প্রক্রিয়া নিয়ে আরও ভাবতে হবে।
নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলা কাগজ : স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এবং প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান বলেছেন, পদ্মা সেতুর বিষয়ে আমরা বঞ্চিত হই নি; বরং এমন একটি ইতিহাস প্রসিদ্ধ প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়ে তাঁরা (বিশ্বব্যাংক) বঞ্চিত হয়েছে। পরে যদিও অর্থায়নের কথা বলেছিলো, কিন্তু আমরা নিই নি। এখন তাঁদেরকে তাঁদের ঋণ প্রক্রিয়াকে নিয়ে আরও বেশি ভাবতে হবে।
আজ শনিবার (১৮ জুন) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘শেখ হাসিনার পদ্মা সেতু নির্মাণ : বিশ্ব ব্যবস্থায় বাংলাদেশ তথা উন্নয়নশীল দেশসমূহের এক যুগান্তকারী বিজয়’ শীর্ষক এক সেমিনারে এসব কথা বলেন স্পিকার ও ড. মসিউর।
সেমিনারটির আয়োজন করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক উপ-কমিটি।
স্পিকার বলেন, যাঁরা অংশীজন, তাঁদের সবার প্রতি ন্যায্যতা করতে হবে- এটা আমরা শুনে থাকি। কিন্তু পদ্মা সেতুর ব্যাপারে কী হলো? বিশ্বব্যাংক হঠকারীভাবে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের ভিত্তিহীন অভিযোগ করে। সেই কথিত দুর্নীতির প্রমাণ চাওয়ার পরও আমরা পাই নি। লেনদেন ব্যতীত অনুমান নির্ভরতার ওপর ধারণা করে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ায়।
স্পিকার বলেন, ‘পদ্মা সেতু দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন। আজ আর স্বপ্ন নয়। আজ বাংলাদেশের বাস্তবতা, আমাদের অহংকার। বাঙালির আত্মনির্ভরতার এক অনন্য উদাহরণ, অতুলনীয় নিদর্শন।’
তিনি বলেন, ‘চাপের কাছে নতি স্বীকার না করে, নিজস্ব অর্থায়নে শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনাকে ধন্যবাদ।’
‘পদ্মা সেতু কেবল ইট-পাথরের নির্মিত সেতু নয়’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘এর সাথে জড়িয়ে আছে লক্ষ-কোটি বাঙালির আবেগ। আমাদের ভালোবাসা, আমাদের গৌরব। দেশের মানুষ সেদিন শক্তি যুগিয়েছিলো; কারণ মানুষের শক্তিতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বাস করেন। আমরা আজ আমাদের সক্ষমতাকে উদ্যাপন করছি।’
স্পিকার বলেন, আবারও প্রমাণ হয়েছে, বাঙালি জাতি যে কোনও প্রতিকূল পরিবেশে ঘুরে দাঁড়াতে পারে, আমরা পারি। পদ্মা সেতু আমাদের বিজয়ের প্রতীক, উন্নয়নের প্রতীক, ঘুরে দাঁড়ানোর প্রতীক, আমাদের হার না মানার প্রতীক, আমাদের সক্ষমতার প্রতীক।
নিজের পরিবারে পদ্মা সেতু নিয়ে আলোচনার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, পদ্মা সেতু নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সর্বত্র। বাড়িতেও আলোচনা। ছেলেমেয়েদের সাথে আলোচনা হয়।
ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, ‘আমার মেয়ের বয়স ২৮ আর ছেলের ১৮। তাঁদের সাথে আলোচনায় যে অভিমত পাই, মেয়ে বলেছে, পদ্মা সেতু আমাদের নেতা শেখ হাসিনার সাহসের প্রতীক। শেখ হাসিনার দৃঢ়তার প্রতীক। ছেলে বলেছে, পদ্মা সেতু আমাদের নৈতিক সততার প্রতীক। ভবিষ্যতের সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রতীক। তরুণ প্রজন্ম আজ প্রস্তুত। পদ্মা সেতুর স্পিরিটকে ধারণ করে তারা এগিয়ে যাবে।
পদ্মা নদীর বুকে নিজস্ব অর্থায়নে ৩০ হাজার কোটি টাকায় ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুর কাজ ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এরপর ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটিতে বসে প্রথম স্প্যান। মাঝে ২২টি খুঁটির নিচে নরম মাটি পাওয়া গেলে নকশা সংশোধনের প্রয়োজন হয়। তাতে বাড়তি সময় লেগে যায় প্রায় ১ বছর।
করোনাভাইরাস মহামারি আর বন্যার মধ্যেও কাজের গতি কমে যায়। সব বাধা পেরিয়ে অক্টোবরে বসানো হয় ৩২তম স্প্যান। এরপর বাকি স্প্যানগুলো বসানো হয়ে যায় অল্প সময়ের মধ্যেই। ঠিক ৫ বছরের মাথায় পূর্ণ আকৃতি পায় স্বপ্নের সেতু, যুক্ত হয় পদ্মার দুই পাড়।
দেশের বৃহৎ এই অবকাঠামো আগামী ২৫ জুন উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা।
দীর্ঘ প্রতীক্ষিত এই সেতুর উদ্বোধন অনুষ্ঠান ঘিরে পদ্মার দুই পাড়েই নেওয়া হয়েছে নানা আয়োজন।
সিরডাপ মিলনায়তনের সেমিনারে প্রধানমন্ত্রীর অর্থ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী সামসুল আলম, অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আইনুন নিশাত, সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার গোলাম রহমান বক্তব্য দেন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সেলিম মাহমুদ।
ড. মসিউর রহমান বলেন, ‘পৃথিবীর বহু দেশে, বহু সময় অবকাঠামোগত প্রকল্প হচ্ছে। কিন্তু পদ্মা সেতুর মতো জটিল নদী ব্যবস্থায় প্রকল্প আগামী এক-দেড় শ বছরেও হবে না। বিশ্বব্যাংক এ রকম একটি বড় ও ইতিহাস প্রসিদ্ধ প্রকল্প থেকে নিজেকে বঞ্চিত করেছে, আমরা বঞ্চিত হই নি।’
অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ বলেন, ‘আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পদ্মা সেতুর জন্য আমাদের মর্যদা বেড়েছে। নিজের টাকায় করলাম। এর আগে প্রধানমন্ত্রী যখন ঘোষণা দিয়েছিলেন, তখন এই বার্তা পৌঁছে গিয়েছিলো। এই মর্যাদা আমাদের সবার, সারা বাঙালি জাতির গৌরব। এর জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিতে হবেই।’
পানি সম্পদ বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত বলেন, ‘পদ্মা সেতুর পরিকল্পনা ও ডিজাইন কাজে আমি যুক্ত ছিলাম। প্রথমদিকে মনে হচ্ছিলো প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। এই সেতু থেকে আমরা অনেক কিছু শিখেছি। যখন কোনও প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা অর্থায়ন করে তখন কিছু প্রক্রিয়া আছে। পরে তাঁরা ফিরতে চেয়েছিলো, প্রধানমন্ত্রী তাঁদের নেন নি।
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, অনেকে বলছেন, অনেক টাকা লেগে গেলো। ১০ হাজার ১ শ কোটি টাকা মূল্যস্ফীতি ধরলে ২৪ হাজার কোটি টাকা হয়ে যায়। নদীর শাসন ১৪ কিলোমিটার হলো। সেখানে টাকা গেলো। পিয়ার গভীরে গেলো। অতিরিক্ত কোনও ব্যয় হয় নি।
পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংক অর্থায়নের পেছনে আর্থিক কারণ নয়, বরং ষড়যন্ত্র ছিলো বলেই মন্তব্য করেন তিনি।