ডন প্রতিবেদক, চাঁদপুর : চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি অধিগ্রহণ নিয়ে নিজ পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। তিনি বলেছেন, তাঁর পরিবারকে জড়িয়ে যে কথা বলা হচ্ছে, তা অসত্য ও ভিত্তিহীন। তিনি চান, যে অভিযোগ উঠেছে, সেটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাইরে কারও মাধ্যমে তদন্ত হোক। এ বিষয়ে তিনি আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও ভাবছেন।
বৃহস্পতিবার (২৭ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় রাজধানীর হেয়ার রোডের সরকারি বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি এসব কথা বলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়টির জন্য ভূমি অধিগ্রহণের আগেই সেখানকার জমি মৌজা দরের চেয়ে ‘অস্বাভাবিক’ বেশি দাম দেখিয়ে দলিল করে নিয়েছে প্রভাবশালী একটি মহল, যারা এলাকায় শিক্ষামন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। এ বিষয়ে বাঙলা কাগজ ও ডনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরের পরিপ্রেক্ষিতে নিজের অবস্থান জানাতে সংবাদ সম্মেলনে আসেন শিক্ষামন্ত্রী।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে মন্ত্রিসভায় চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের খসড়াটি অনুমোদন হয়। পরের বছর মে মাস থেকে প্রভাবশালী গোষ্ঠীটি জমি কেনা শুরু করে।
সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য যে জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে, সেখানে তাঁর এবং তাঁর পরিবারের কারও কোনও জমি নেই। ভূমি অধিগ্রহণ থেকে পরিবারের আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার কোনও সুযোগ নেই। তিনি বলেন, ‘আমার বা আমার পরিবারকে জড়িয়ে রিপোর্ট ভিত্তিহীন ও অসত্য। আমি বলব উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই কেউ এই কাজটি করছেন।’
এক সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিলো, তাহলে আইনগত ব্যবস্থা নেবেন কি না। জবাবে দীপু মনি বলেন ‘আমি সেটা নিয়েও ভাবছি। সব কাগজপত্র দেখছি, আমি ব্যবস্থা নেবো। কারণ, এটা যদি বড় ষড়যন্ত্রের জাল হয়, তাহলে এক রকম। আর যদি কেউ না বুঝে করে থাকেন, তাহলে আরেক রকম। কিন্তু না বুঝে করার কারণ দেখি না। এটি উদ্ঘাটন হওয়া উচিত।’
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, প্রথম কথা হলো, ক্রয়সূত্রে চাঁদপুরে কোথাও তাঁর কোনও জমি নেই। দ্বিতীয়ত, যে জায়গার কথা বলা হচ্ছে, সেই লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নে একটি হাসপাতাল ও বৃদ্ধাশ্রম করার জন্য তাঁর ভাই (জাওয়াদুর রহিম ওয়াদুদ) অল্প অল্প করে কিছু জায়গা কিনেছিলেন। কিন্তু জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়াটি শুরু হলে তাঁর ভাই জমিটি বিক্রি করে দেন, হস্তান্তর করে দেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, যেহেতু জায়গাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অধিগ্রহণ করা হচ্ছে এবং তাঁর বোন (দীপু মনি) শিক্ষামন্ত্রী।
অস্বাভাবিক দাম দেখিয়ে যাঁরা জমির দলিল করে নিয়েছেন বলে অভিযোগ এসেছে, তাঁদেরমধ্যে আছেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সেলিম খান ও ফরিদগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান জাহিদুল ইসলাম। তাঁরা এলাকায় মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত।
দীপু মনি বলেন, কিছু লোকের কথা বলা হয়েছে যে তাঁরা তাঁর পরিবারের সদস্য। কিন্তু তাঁরা কেউ তাঁর পরিবারের সদস্য নন। রক্তের দিক থেকে পরিবারের সদস্য না হলেও তাঁরা সবাই তাঁর রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য। তাঁদের কারও সেখানে জমি থাকতে পারে। কেউ যখন জমি কেনেন, নিশ্চয়ই তখন সেটি তাঁকে জিজ্ঞাসা করে কেনেন না। এটি তাঁদের ব্যক্তিগত ব্যাপার।
বাঙলা কাগজ ও ডনসহ কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের কথা বলতে গিয়ে দীপু মনি বলেন, জাহিদুল ইসলামকে বলা হচ্ছে তাঁর মামাতো ভাই। কিন্তু তিনি তাঁর মামাতো ভাই নন। তাঁর নানা এবং তাঁর দাদা কাজিন। সম্পর্কটি রাজনৈতিক ও ঘনিষ্ঠ বলে উল্লেখ করেন দীপু মনি।
সেলিম খানের বিষয়ে দীপু মনি বলেন, তিনি একটি ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং নৌকা প্রতীকের চেয়ারম্যান। সুতরাং খুব স্বাভাবিকভাবেই তাঁর ২০টি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের মতো সেলিম খানের সঙ্গেও সে রকমই সম্পর্ক।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, অধিগ্রহণের জন্য জমির মূল্য নির্ধারণ করে জেলা প্রশাসন। প্রথমে একটি প্রাক্কলন প্রস্তুত করা হয়েছিল। সেটি অনুযায়ী সেই জমির দাম দাঁড়ায় ৫৫৩ কোটি টাকা। এখানে ৬২ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। পরে আরেক কমিটি করে প্রাক্কলন করা হয়, যার মূল্য ১৯৩ কোটি টাকা। তাহলে ১৯৩ কোটি টাকার ২০ গুণ কী করে ৫৫৩ কোটি টাকা হয়?
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দীপু মনি বলেন, সরকার ও রাষ্ট্রের বহু কর্তৃপক্ষ আছে, এখানে দুর্নীতি হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে পারেন। তিনি বলেন, ‘আমি চাইবো, দাবি করবো, সেভাবে যেনো এটি তদন্ত হয় এবং এতে কেউ যদি কোনোভাবে জড়িত থাকে, তাদের বিরুদ্ধে যেন যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এখানে যা কিছু ঘটে থাকুক না কেন, তদন্ত হওয়া উচিত এবং সেটি প্রকাশিত হওয়া উচিত।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ নিয়ে তদন্ত করবে কি না, জানতে চাইলে দীপু মনি বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তদন্ত হলে গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। তাই অন্য জায়গা থেকে তদন্ত হলেই ভালো হয়। সেটি ভূমি মন্ত্রণালয়ও করতে পারে বা অন্যরা করতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয়টির জন্য ভূমি অধিগ্রহণ বিষয়ে চাঁদপুর-৪ আসনের ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ মুহম্মদ শফিকুর রহমান একটি অনলাইন গণমাধ্যমে মতামত কলামে লিখেছিলেন। এই লেখায় তিনি অভিযোগ করেন, শিক্ষামন্ত্রীর ক্ষমতা ও তাঁর ভাইবেরাদর জড়িত। তাই কেউ মুখ খুলছিল না।
এ ছাড়া চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নাসির উদ্দিন আহমেদ নিজ বাসায় দলের নেতা-কর্মীদের নিয়ে সভা করেও এ বিষয়ে কথা বলেন।
এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দীপু মনি বলেন, দলের জেলা সভাপতির জন্য দলীয় ফোরাম ছিলো। আর দলীয় সংসদ সদস্যের জন্য পার্লামেন্টারি পার্টির ফোরাম ছিলো। সেটি না করে তাঁরা গণমাধ্যমে নিয়ে গেছেন। তবে তিনি (শিক্ষামন্ত্রী) দলের শৃঙ্খলার বাইরে যেতে পারেন না। সংসদ নেতা আছেন, স্পিকার আছেন, প্রধান হুইপ আছেন। আর দলের সংসদ নেতা, সাধারণ সম্পাদক এবং চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বে থাকা নেতাদের কাছে জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে তিনি ফোরামের বাইরে মন্তব্য করতে চান না।