নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলা কাগজ : আড়াই হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ আত্মসাৎ করে দেশত্যাগী প্রশান্ত কুমার হালদারের (পি কে হালদার) অপকর্মের তদন্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন কর্মকর্তার নাম এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী ও নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম এসব তথ্য দিয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার (২৯ মার্চ) দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা এ তথ্য দেন। তবে তাঁরা অর্থ লোপাটে নিজেদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেছেন।
দুদকের দায়িত্বশীল একটি সূত্র বাঙলা কাগজ ও ডনকে এ তথ্য জানিয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও এফএএস লিজিং নামের দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামে আড়াই হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় সকাল ১০টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা এস কে সুর চৌধুরী ও শাহ আলমকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
সূত্রটি জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে এস কে সুর চৌধুরী ও শাহ আলম অর্থ লোপাটে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ও বর্তমান একজন ডেপুটি গভর্নর, একাধিক মহাব্যবস্থাপক ও নির্বাহী পরিচালকের নাম বলেছেন- যাঁরা এ সম্পর্কিত নথিপত্রে সই করেছেন এবং প্রশান্ত কুমার হালদারের (পি কে হালদার) সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক ছিলো বলেছেন। তবে দুই কর্মকর্তা অর্থ আত্মসাতে নিজেদের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেন। জিজ্ঞাসাবাদে অনেক বিষয়ে দুদকের পাল্টা প্রশ্নে তারা নিশ্চুপ ছিলেন।
বেলা দুইটায় জিজ্ঞাসাবাদ শেষে দুদক থেকে বের হওয়ার সময় সাংবাদিকেরা কথা বলতে চাইলে দুজনই এড়িয়ে যান। শুধু এস কে সুর চৌধুরী বলেন, ‘আমার যা বলার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে বলেছি।’
জানা গেছে, এস কে সুর চৌধুরী ও শাহ আলমকে কখনো আলাদা, আবার কখনো এক জায়গায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এ সময় দুদকের পরিচালক বেনজির আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।
ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও এফএএস লিজিং থেকে অর্থ লোপাটের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুদক ২৪ মার্চ এস কে সুর চৌধুরী ও শাহ আলমকে তলবি নোটিশ পাঠায়।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুদক সূত্র আরও জানায়, কোনও রকম জামানত ছাড়া প্রতিষ্ঠানের বিধিবিধান লঙ্ঘন করে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, পিপলস লিজিং, এফএএস ফাইন্যান্সের হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে পি কে হালদার চক্র।
সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রাশেদুল হক, এফএএস ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাসেল শাহরিয়ারসহ ১২ কর্মকর্তা ও ঋণ গ্রাহককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে ১০ জন দোষ স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।
ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের এমডি রাশেদুল হক গত ২ ফেব্রুয়ারি আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে বলেছেন, পি কে হালদারের ক্ষমতার উৎস ছিলো বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর ও নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম। পি কে হালদার বিভিন্ন সময় আর্থিক সুবিধা ও মূল্যবান উপঢৌকন দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের ওই দুই কর্মকর্তাকে বশে রেখে দুর্নীতির মাধ্যমে অবাধে অর্থ লোপাট করেছেন।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, পি কে হালদারের দুর্নীতির সময়কালে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন শাহ আলম। এই যোগসূত্র থেকে পি কে হালদার ও শাহ আলমেরমধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। রাশেদুল হকের জবানবন্দিতে শাহ আলমের নাম এলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করে নি। শুধু তাঁকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগ থেকে সরিয়ে অন্য বিভাগের দায়িত্ব দেয়। ওই সময় এস কে সুর ও শাহ আলমের বিরুদ্ধে দুর্নীতির রেকর্ডভিত্তিক কোনও তথ্য–প্রমাণ না থাকায় দুদক তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করতে পারে নি।
এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ও বর্তমান দুই কর্মকর্তার দুর্নীতি বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে।
ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় এ পর্যন্ত ২২টি মামলা হয়েছে এবং এফএএস লিজিংয়ের অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় হয়েছে ১৩টি মামলা।
জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে দুদকের সচিব মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, আইএলএফএসএলের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাশেদুল হককে গত বছর দুদক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে পায়, ওই জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তিনি দোষ স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।
জবানবন্দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম এবং ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরীর নাম বেশি এসেছে, যারা লিজিং লুটের নেপথ্যে ছিলেন। দুদক এ দুজনকে গতকাল তলব করে।
তাঁদের বক্তব্য তদন্ত কর্মকর্তা রেকর্ড করেছেন। পরে তদন্ত কর্মকর্তা তাঁদের বক্তব্যেরসঙ্গে তথ্য উপাত্ত মিলিয়ে দেখবেন এবং সেভাবেই আইনগতভাবে পরের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে দুদকের সচিব বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান হোক বা যে কোনও প্রতিষ্ঠানই হোক, যদি আইনবহির্ভূত কোনও কিছু করে তাহলে দুদক ব্যবস্থা নেবে।