ইজিবাইক খাত থেকে কে কীভাবে টাকা কামাবে সেটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে : মাহা মির্জা
নিজস্ব প্রতিবেদন, বাঙলার কাগজ : উন্নয়ন গবেষক মাহা মির্জা বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক। কিছুদিন তিনি ভার্জিনিয়া কমনওয়েলথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। দীর্ঘদিন তিনি দেশের শ্রমজীবী মানুষ, ইজিবাইক ও অটোরিকশা, জ্বালানি খাত, পাটকল উচ্ছেদসহ বিভিন্ন ইস্যুতে লেখালেখি, প্রকাশনা ও সাংগঠনিক তৎপরতায় যুক্ত। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার ওল্ড ডমিনিয়ন ইউনিভার্সিটি থেকে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর এবং জার্মানির ইউনিভার্সিটি বিলেফিল্ড থেকে রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানে পিএইচডি করেন। সমকালের পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সহসম্পাদক ইফতেখারুল ইসলাম।
প্রশ্ন : আপনি সড়কে ইজিবাইক বা ব্যাটারিচালিত বা ইঞ্জিনচালিত রিকশা চলাচলের পক্ষে লিখে আসছেন। কেন আপনার এ অবস্থান?
মাহা মির্জা : ব্যাটারিচালিত রিকশা স্থানীয় পুঁজি, স্থানীয় ডিজাইন এবং স্থানীয় উদ্যোগে তৈরি হওয়া বাংলাদেশের একটা শক্তিশালী ইন্ডাস্ট্রি। গরিবের বাহন হিসেবে সারাদেশে এর চাহিদা আছে। অটোরিকশা ঘিরে সারাদেশে তৈরি হয়েছে হাজার হাজার পার্টসের দোকান, মেরামতের ওয়ার্কশপ, ইজিবাইকের গ্যারেজ আর টায়ারের দোকান। শুধু অটোরিকশাচালক না; মোটর মিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি, পেইন্টার, বিদ্যুৎ মিস্ত্রি, ইঞ্জিনের মিস্ত্রি, মেকানিক, সহকারী– এভাবে উৎপাদক, সংযোজক, চালক, মেরামত মিলিয়ে গত এক-দেড় দশকে এই দারুণ ইন্ডাস্ট্রিটা তৈরি হয়েছে। দেশি কোম্পানিগুলো দেশেই ব্যাটারি সংযোজন করছে। অটোরিকশা কোনো রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা, ভর্তুকি, প্রণোদনা পায়নি। অথচ স্থানীয় উদ্যোগে সারাদেশে ৬০ থেকে ৭০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান করেছে। বাংলাদেশে গার্মেন্টস ছাড়া আর কোনো শিল্প এত লাখ লাখ কর্মসংস্থান করতে পেরেছে? এই শিল্পের পক্ষে লিখব না, কোন শিল্পের পক্ষে লিখব?
প্রশ্ন : কিন্তু এ ধরনের যানকে শুধু ঢাকা নয়, প্রায় সব শহরেই যানজটের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হয়।
মাহা মির্জা : যানজটের প্রধান কারণ অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং গণপরিবহনের অভাব। সবচেয়ে বড় কারণ– হুহু করে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বেড়ে যাওয়া। প্রতিবছর গড়ে ১৫-২০ হাজার প্রাইভেটকারের লাইসেন্স দিচ্ছে বিআরটিএ। বিআরটিএ বলছে, ২০১০ সালে প্রাইভেটকারের সংখ্যা ছিল দেড় লাখ। ২০২০-এ এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে তিন লাখে। এর মধ্যে বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজের মতো বিলাসী গাড়ির আমদানি বেড়েছে ৩০০ পার্সেন্ট! পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব গাড়ি শহরের মাত্র ৪ শতাংশ যাত্রী বহন করে। অথচ রাস্তার ৭৫ শতাংশ জায়গা দখল করে থাকে! এই যে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা দ্রুতগতিতে বাড়ল; সে তুলনায় রাস্তার সংখ্যা কি বেড়েছে? কে বেশি জায়গা নেয়? গাড়ি, না রিকশা?
প্রশ্ন : সে জন্য গণপরিবহন বাড়ানো যেতে পারে। অটোরিকশা বাড়ানো কি সমাধান?
মাহা মির্জা : আমরা জানি, বিআরটিসি ভারত থেকে শত শত বাস কেনে; তারপর সেগুলো ডিপোতে পড়ে নষ্ট হয়। এটা ঠিক, ভালো মানের পর্যাপ্ত বাস রাস্তায় থাকলে এভাবে লাখে লাখে প্রাইভেটকার আমদানির প্রয়োজন পড়ে না। এসব কাঠামোগত সমস্যাকে না ধরে, প্রাইভেট গাড়িকে ‘ক্লিন চিট’ দিয়ে, সরকারের গ্রামমুখী কর্মসংস্থান তৈরির ব্যর্থতা নিয়ে একটা কথাও না বলে শুধু ‘অটোরিকশাতে যানজট হয়’ বললে তো হবে না।
প্রশ্ন : সরকার বারবার ইজিবাইক বন্ধের ঘোষণা দিলেও, এসব যান ও এর যন্ত্রাংশ আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা নেই।
মাহা মির্জা : বাংলাদেশ যে কীভাবে চলে, এটাই তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। আমদানিকারকদের পার্টস এবং ‘বডি’ আমদানি করার অনুমোদন আছে। এত দিন কোটি টাকার পার্টস আমদানি হয়েছে, বিক্রিও হয়েছে। গাজীপুরেই তিন সড়কের মোড় থেকে টাকশাল পর্যন্ত প্রায় অর্ধশত শোরুম আছে। অথচ বেকার তরুণ ধারদেনা করে ইজিবাইক কিনে রাস্তায় নামলেই ধরপাকড় হচ্ছে। বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি আসছে। এখানে একটা ব্যাপার খুব পরিষ্কার। ইজিবাইক সত্যি বন্ধ করতে চাইলে পার্টসের আমদানি বন্ধ করা দরকার ছিল। আমদানিকারকদের সঙ্গে বসা দরকার ছিল। কিন্তু এই ব্যবসার সঙ্গে প্রভাবশালী মহল জড়িত। তারা টাকাপয়সা ইনভেস্ট করেছে। নতুন এক ধনী কোম্পানি ঘোষণা দিয়ে গাজীপুরের হোতাপাড়ায় কয়েকশ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ইজিবাইক তৈরির অ্যাসেমব্লি লাইন পর্যন্ত বসিয়েছে। পত্রিকায় সেটার বিজ্ঞাপনও আমরা দেখেছি। অর্থাৎ নতুন ফ্যাক্টরি স্থাপন করার অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে; চায়না থেকে পার্টস আমদানিও বন্ধ করা হচ্ছে না। অথচ লোকাল মেকানিকদের তৈরি স্থানীয় ইজিবাইক যখন রাস্তায় নামছে, তখনই বন্ধ করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। তার মানে এটা স্পষ্ট, ইজিবাইক বন্ধ করা বা যানজট কমানো এখানে উদ্দেশ্য নয়, বরং অনেক বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর নজর পড়েছে এই সেক্টরে।
প্রশ্ন : তার মানে, ক্ষমতাশালীদের দ্বন্দ্বের কারণেই সরকার স্থির সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না?
মাহা মির্জা : এই বাহনের চাহিদা এমনভাবে বেড়েছে, এই খাত থেকে কে কীভাবে টাকা কামাবে, ব্যবসা করবে, সেটাই এখানে মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। একবার বন্ধের ঘোষণা আসে, আরেকবার পার্টস আমদানির পক্ষে সিদ্ধান্ত আসে। অর্থাৎ এই সেক্টর ঘিরে অনেক রকম অর্থনৈতিক স্বার্থ তৈরি হয়েছে। সরকার এক ঘোষণায় ইজিবাইক হয়তো বন্ধ করতে পারে, কিন্তু বৃহৎ ব্যবসায়ীদের ব্যবসা বন্ধ করা তো সোজা না। তা ছাড়া সরকারি লোকজন নিজেরাও তো এসব ভাগবাটোয়ারার অংশ।
প্রশ্ন : গ্রাম ও শহরে প্রায় একই গতিতে ইজিবাইকের চাহিদা বেড়ে গেল। এতে বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার বিশেষ কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়?
মাহা মির্জা : গ্রামের ক্ষেত্রে ইজিবাইকের চাহিদা বেড়েছে বেশ কিছু কারণে। গ্রামে রাস্তাঘাটের সংখ্যা বেড়েছে এবং যাতায়াতের পরিধি বেড়েছে। মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বেড়েছে, গ্রামীণ মানুষ আগের চেয়ে বেশি বাজারমুখী হয়েছে, কৃষিপণ্য পরিবহনের জন্যও ইজিবাইক ব্যবহৃত হচ্ছে। কাজের খোঁজেও মানুষের যাতায়াত বেড়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খুব অর্গানিক্যালি এসব পরিবর্তন ঘটে। তবে ইজিবাইক বৃদ্ধির সঙ্গে গ্রামীণের শ্রমজীবী মানুষের আগের চেয়ে ভালো থাকা বা খারাপ থাকার সম্পর্ক এত সরল না। সামগ্রিকভাবে গ্রামে কাজ নেই। ধান কাটা বা ধান বোনার সময়টুকু ছাড়া বছরে ছয় মাসই গ্রামীণ ক্ষেতমজুরের একটা বড় অংশ বেকার থাকে। তাদেরই একটা অংশ আশপাশের জেলায় অটোরিকশা চালাতে আসে। মৌসুমি অটোরিকশাচালকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় বরং এটাই বোঝা যায়, গ্রামীণ অর্থনীতি কতটা স্থবির, অনিশ্চিত এবং কর্মহীন। আর শহরের ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে, জনসংখ্যা যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, সে তুলনায় গণপরিবহনের সংখ্যা বাড়েনি। কিন্তু শহরাঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই শ্রমিক পরিবার বা নিম্ন আয়ের পরিবার। তাদের তো আর ব্যক্তিগত গাড়ি নেই। একদিকে প্রয়োজনের তুলনায় পর্যাপ্ত বাস নেই, তার ওপর গত কয়েক বছরে ১০ টাকার বাস ভাড়া বেড়ে ২৫ টাকা হয়েছে। এই বাজারে দরিদ্র মানুষের পক্ষে প্রতি মাসে দেড়-দুই হাজার টাকা বাস ভাড়া দেওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানে ইজিবাইকে চড়লে শেয়ারে ৫ থেকে ১০ টাকায় অনেক দূর যাওয়া যায়।
প্রশ্ন : ব্যাটারি বা ইঞ্জিনচালিত রিকশার বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ– এর ফলে প্রচুর বিদ্যুৎ অপচয় বা চুরি হয়।
মাহা মির্জা : ধরে নিলাম, ইজিবাইকের ব্যাটারি চার্জ করতে প্রচুর বিদ্যুৎ চুরি হয়। কিন্তু এই চুরির বেনিফিশিয়ারি কারা? আপনাকে অন্যভাবে উত্তরটা দিই। দেশে একের পর এক মেগা বিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি করা হচ্ছিল, তাও আবার বিদেশি ঋণের টাকায় এবং অতিরিক্ত খরচে। তখন বলা হলো, আমাদের বিপুল বিদ্যুৎ দরকার। কেন দরকার? কারণ বিদ্যুৎ ছাড়া শিল্পায়ন সম্ভব না। আর শিল্পকারখানা তৈরি না হলে কর্মসংস্থান তৈরি হবে না। এখন উন্নয়নের দেড় দশকে আমরা কী দেখলাম? শিল্পায়নের নামে, কর্মসংস্থানের নামে বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে বিদ্যুৎ প্রকল্প করা হলো, অথচ কয়টা শিল্পকারখানা তৈরি হয়েছে? কয়টা কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে? বরং আমরা দেখছি, শিল্পকারখানা থেকে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে। বেকারত্ব অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। অথচ পাবলিক মানি দিয়ে যে ২৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা তৈরি হলো, সেটা দিয়ে এত দিনে শিল্পায়নের জোয়ার বয়ে যাওয়ার কথা। সেই শিল্পায়ন কোথায়? অথচ মাঝখান থেকে গড়ে উঠেছে একটা জরুরি লোকাল ইন্ডাস্ট্রি। ৬০-৭০ লাখ কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে স্ব-উদ্যোগে। সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নতুন নতুন শিল্পায়ন হলে সেখানে বিদ্যুৎ লাগত না? একটা ইপিজেড চালাতে বিদ্যুৎ লাগে না? এক লাখ স্কয়ার ফিটের একটা বিশাল বদ্ধ এলাকার অভিজাত মল চালাতে বিদ্যুৎ লাগছে না?
প্রশ্ন : এগুলো তো শিল্প; এখানে কর্মসংস্থান হচ্ছে।
মাহা মির্জা : অটোরিকশাও তো একটা শিল্প। শক্তিশালী লোকাল শিল্প। কৃষির পরেই সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান তৈরি করা শিল্প। পাবলিক মানিতে যে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে, সেই বিদ্যুৎ পাবলিকের কর্মসংস্থানেই তো ব্যবহার হওয়ার কথা ছিল। সেটাই হয়েছে। আর অটোরিকশাচালক বিদ্যুৎ চোর হলে সরকারের সঙ্গে যোগসাজশ করে এক লক্ষ কোটি টাকার ‘ক্যাপাসিটি পেমেন্ট’ বাগিয়ে নিল যেসব রেন্টাল কোম্পানি, তারা কী? কোনটা বড় চুরি?
প্রশ্ন : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মাহা মির্জা : আপনাকেও ধন্যবাদ।